হিন্দুধর্মে
মূর্তিপূজা আর সাহিত্যের সম্পর্ক
ধর্মের তাৎপর্য
ধর্ম শব্দের অনেক অর্থ আছে। যমরাজকেও বলা হয় ধর্মরাজ। চলন্তিকা অভিধানে আছে, ধর্ম শব্দের অর্থ সৎকর্ম
অথবা সমাজ হিতকর বিধি। তবে ধর্ম বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি সেটা সাম্প্রদায়িক
উপাসনা পদ্ধতি, সংস্কার, রীতিনীতি এবং ঈশ্বর পরকাল ইত্যাদি সম্পর্কে তত্ত্ব অথবা
সাধনার মার্গ। ইংলিশ প্রতিশব্দ religion । ঈশ্বর শব্দের প্রচলিত সমার্থক শব্দ ভগবান।
ভগ কথার অর্থ যোনি। ভগবান বলতে বোঝায়
-ঐশর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান, বৈরাগ্য - এই ছয়টি গুনের অধিকারী ব্যক্তি।
তত্ত্বে ঈশ্বর শব্দের ইশ ধাতুর অর্থ আধিপত্য করা। প্রশ্ন হলো - কিসের আধিপত্য। ভাগবতের 1/11/34 শ্লোকে ঈশ্বরের সেই আধিপত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। "এত দীশ নমীশস্য। ...." এই শ্লোকের
গদ্য করলে যে অর্থ দাঁড়ায় সেটা হলো - ঈশ্বরের এতটাই ঈশ্বরত্ব যে প্রকৃতিতে অর্থাৎ
মায়াতে অবস্থিত হয়েও মায়ার দোষ গুনের সঙ্গে কোনো ভাবেই যুক্ত হয় না। অর্থাৎ ঈশ্বরত্ব হলো মানুষের এমন একটা ক্ষমতা
বা গুন্ যাতে মানুষের মন লোভ লালসার ওপর পতিত হলেও লিপ্ত হয় না।
হিন্দুধর্ম
হিন্দুধর্ম আর হিন্দু সমাজ এই নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। হিন্দু একটি ধর্ম সম্প্রদায় নাকি একটি সমাজ সংঘঠন। নির্মল কুমার বসু তাঁর 'হিন্দু সমাজের গঠন' গ্রন্থে
হিন্দু ধারণাটা কী ধরণের সেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। হিন্দু গুরু শঙ্করাচার্য ( 744-820
মতান্তরে জন্ম 686 খ্রিস্টাব্দ ) হিন্দু ধর্মের প্রচার আর বিস্তার প্রসঙ্গে নিরাকার
ব্রহ্মের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন বিশ্বব্যাপি চেতনার কথা। ইংলিশ দর্শনে যেটা বলা হয় cosmic consciousness
| তবে হিন্দু দর্শনের সূচনা বৈদিক যুগে। খ্রিস্ট
জন্মের এক হাজার বছর আগে যার সূচনা। প্রথম
হিন্দু দর্শন কপিল মুনির সাংখ্য। সাংখ্য দর্শনে বলা হয়েছে পুরুষ আর প্রকৃতি। পুরুষ হলো একটা অতীন্দ্রিয় ব্যাপার। একটা হাইপোথিসিস। আর প্রকৃতি হলো দেহ। পুরুষ যখন প্রকৃতির সাথে মেলে তখন জড় পদার্থ প্রকৃতি
তে প্রাণ সঞ্চার হয়। মৃত্যু হলে এই পুরুষ প্রকৃতি
ছেড়ে চলে যায়। পরবর্তী কালে এই পুরুষ আর প্রকৃতি
রূপান্তরিত হয়েছে আত্মা আর দেহ তে। আত্মা যখন দেহতে আসে তখন মানুষ জীবন পায়। মানুষকে বলা হয় জীবাত্মা। আর হিন্দু ধর্মে ধরে নেওয়া
হয় যে ভগবান হলো পরমাত্মা। জীবাত্মা আর পরমাত্মা
এই দুইএর মিলন কে মোক্ষ বলা হয়। মোক্ষলাভ কথাটার
অর্থ হলো সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি।
হিন্দু দর্শন অনুযায়ী শাস্ত্রীয় বিচারে ঐশ্বরিক শক্তির তিনটে ভাগ। অন্তরঙ্গা শক্তি, বহিরঙ্গা শক্তি, তটস্থা
শক্তি। মানুষ মাত্রেই তটস্থা। বহিরঙ্গ শক্তি মায়া। অন্তরঙ্গা শক্তি সবসময় বহিরঙ্গা
শক্তির সাথে যুক্ত। অন্তরঙ্গা শক্তির আবার তিনটে ভাগ। সৎ - চিৎ - আনন্দ। সৎ মানে থাকা, চিৎ মানে চেতনা, আর আনন্দ।
তটস্থা অবস্থায় মানুষের তিন প্রকার জ্বালা বা কষ্ট আছে। আধ্যাত্মিক জ্বালা - যেমন
জ্বর, ক্ষুধা, তৃষ্ণা। আদিভৌতিক জ্বালা অর্থাৎ অন্য প্রাণী কর্তৃক আঘাত। আদিদৈবিক জ্বালা - বন্যা, ভূকম্প, দুর্ঘটনা
ইত্যাদি। এই পার্থিব জ্বালা থেকে মুক্তি পেতে আর মন কে পার্থিব লালসা, আসক্তি থেকে দূরে সরিয়ে সৎ - চিৎ - আনন্দ এই
পর্যায় নিয়ে যাওয়ার নাম ঈশ্বর সাধনা। পার্থিব জ্বালা থেকে অন্তরঙ্গার আনন্দ অবস্থার সাথে সংযুক্ত হওয়ার পথই হলো ধর্ম-পথ। ঈশ্বর সাধনার যে মার্গ বা পথ,
সেখান থেকেই এক একটি ধর্মমতের সৃষ্টি।
রামকৃষ্ণদেবের কথায় যত মত তত পথ।। এই পথে এগোনোর জন্য দর্শনে নিরাকার ব্রহ্মের কথা
বলা হলেও সাধারণ মানুষকে ঈশ্বর মার্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য পৌরাণিক দেবদেবীর অবতারণা করা
হয়েছে। পুরানে বিভিন্ন গল্পের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। পৌরাণিক গল্পে আমরা যুগ্ম দেবদেবীর
সন্ধান পাই। শিব-কালী , লক্ষ্মী-নারায়ণ , রাধা- কৃষ্ণ। যদিও শাস্ত্রে যুগ্ম প্রতিমার
পূজা নিষিদ্ধ। আসলে আমরা যখন শিব বা কালী যাকেই অর্চনা করি আমরা আসলে দুজনকেই পূজা
করি। তাই আলাদা করে যুগ্ম মূর্তির পূজার প্রয়োজন
হয়না। সব স্ত্রী দেবতাকে আমরা শক্তি বলি।
নিরাকার ব্রহ্ম
শঙ্করাচার্য চারটি বেদ থেকে চারটি শব্দ নিয়েছিলেন। ঋকবেদের ঐতরেয়
আরণ্যক নামক শাখা থেকে তিনি নিয়েছিলেন প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম। এটা জ্ঞান কান্ড। যজুর্বেদীয় শাখায় বৃহদারণ্যক উপনিষদের বাক্য
হলো অহং ব্রহ্মাস্মি। সামবেদ হলো ঋকবেদের
গানের সংকলন। সামের ছান্দোগ্য বাক্য হলো
তত্বমসি। এটাই মুখ্য তত্ত্ব। অথর্ববেদের বাক্য হলো আয়মাত্মা ব্রহ্ম। এগুলির অর্থ বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় আমি তুমি সবই
ব্রহ্ম। ব্রহ্ম আসলে বিশ্বব্যাপ্ত একটি
চেতনা। শঙ্করাচার্যের মতাবলম্বী দশনামী
সম্প্রদায়ের সকলেই নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করেন।
এনারা মূর্তিপূজার বিরোধী। কারণ
চেতনাকে মূর্তির মধ্যে আবদ্ধ রাখা যায়না।
চেতনা সীমাহীন। মূর্তি মেটেরিয়াল। চেতনা ভাবের সাথে সম্পর্কিত।
এই চেতনার ধারণা পাশ্চাত্য দর্শনেও এসেছে।
লক, হিউম, বার্কলে এনারা বলতেন মানুষ বুদ্ধি দিয়ে শেখে। লিবনিজ (ক্যালকুলাস শাস্ত্রের জনক), ডেকার্টে,
স্পিনোজা এনারা বলতেন মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়ে শেখে।
ইমানুয়েল কান্ট্ বললেন যে মানুষ অভিজ্ঞতা পূর্ব কিছু একটা দিয়ে শেখেন। যেটাকে তিনি বললেন অপ্রায়োরি। এরপর এলেন হেগেল। তিনি ছিলেন ভাববাদী। জার্মান দার্শনিক কার্ল
মার্ক্স্ নিয়ে এলেন মেটেরিয়ালিজম। মার্কিন
সমাজবিদ ম্যাক আইভার এবং পেজ
বললেন যে দর্শনের পরিধি অনিশ্চয়তা
নিয়ে, প্রকারান্তরে মার্ক্সবাদ ডেটারমিসনিস্টিক নিশ্চয়তাবাদ। পারমাণবিক বিজ্ঞানে হাইজেনবার্গ নিয়ে এলেন অনিশ্চয়তাবাদ পদার্থ বিজ্ঞান। হাইজেনবার্গ, স্রোডিংগার, আইনস্টাইন এনারা
পদার্থ আর অনিশ্চয়তা কে সংযুক্তিকরণ করলেন।
উপনিষদ লেখা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ থেকে ৫০০ সালের
মধ্যে। প্রায় ২০০ টি উপনিষদের মধ্যে অধিকাংশ উপনিষদ বৌদ্ধ দর্শনের সমসাময়িক। বৌদ্ধ
দর্শন নিরাকারবাদী। উপনিষদের মূল ভাবনা নিরাকার ব্রহ্ম। উপনিষদের ভাষা বৈদিক। বৈদিক
ভাষা হলো পিচ অ্যাকসেন্ট। প্রকারান্তরে মূর্তি পুজো পদ্ধতি সংস্কৃততে লেখা। সংস্কৃত
স্ট্রেস অ্যাকসেন্ট। নিরাকারবাদ পালিতে প্রচলিত। পুতুলপুজো প্রাকৃতে আদৃত।
মূর্তি পুজোর
প্রয়োজনীয়তা
সীমার মাঝে অসীম কে সন্ধান করতে চেষ্টা করা
মূর্তিপূজা ছাড়া পদ্ধতিগত ভাবে অসম্ভব হয়ে ওঠে। তত্ত্বগত ভাবে কারণ অনুসন্ধান করতে
গেলে বুঝতে হবে আচার্য ভরতের সূত্রকে। আর এই সূত্রের মধ্যে আছে সাহিত্য আর ধর্মের
সংযোগ সূত্র। আচার্য ভরতের সূত্র ধর্ম পথে সম্পূন প্রয়োগ করা যায় কিনা সেটা
বিচার্য। তবে সেই বিভেদ আলোচনা করার আগে ভরতের সূত্র সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক।
জ্ঞানযোগ অধ্যায়ে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন যে
মূল বেদে মূর্তিপূজার উল্লেখ নেই। স্বামী
বিবেকানন্দ তাঁর বাণী ও রচনাতে পুতুল পুজোর প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে মানুষ তাঁর বাবা বা মায়ের ছবিকে
প্রণাম করে, পুজো করে, শ্রদ্ধা করে।
ছবি তো মূর্তি বা পটেলিকা। সেটা বাস্তব নয়। তবু আমরা বাবা বা মায়ের ছবিকে পা দিয়ে মাড়াতে
পারিনা বা থুথু ফেলতে পারিনা। কারণ ওই ছবি
আমাদের মনে বাবা বা মা সম্পর্কে ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা জাগায়। ছবি আমাদের সাথে বাবা বা মা কে সংযুক্ত করে। এক সূত্রে বাঁধে। ভগবান আর ভক্তের মধ্যেও সেই
রকম সম্পর্ক। মূর্তি বা ছবির মধ্যে দিয়ে
মানুষ ভগবানকে কল্পনা করে। এটাই সাধনার
মার্গ বা পথ। মূর্তি পুজো বা পুতুল পুজোর
প্রাসঙ্গিকতা সেইখানে। মূর্তির মধ্যে দিয়ে আমরা ঈশ্বরের সাথে সংযুক্ত হই। রামকৃষ্ণদেব
মা কালীর মূর্তিকে মাতৃজ্ঞানে অর্চনা করতেন।
রামকৃষ্ণদেব বিবেকানন্দকে বলেছিনলেন যে উনি ভগবান দেখেছেন এবং বিবেকানন্দকে ভগবান দেখতে
পারেন।
মানুষের মনে ভালোবাসা, রাগ, ঘৃণা, ভয় ইত্যাদি অনুভূতি আছে। এই অনুভূতির শাস্ত্রীয় নাম ভাব। এগুলোর মধ্যে কিছু ভাব স্থায়ী, কিছু ভাব অস্থায়ী। ভারতীয় দর্শনে আচার্য ভরত (600 AD) এই ভাবের কথা
বলেছেন। পাশ্চাত্য দর্শনে ইমানুয়েল কান্ট্
(22 April 1724 – 12
February 1804) A priori knowledge, [in Western
philosophy since the time of Immanuel Kant, knowledge that is independent of
all particular experiences, as opposed to a posteriori knowledge, which derives
from experience.] কনসেপ্ট নিয়ে এসেছেন। ভারতীয়
দর্শন হিসেবে ভরতের সূত্র বিশ্বমানের তত্ত্ব কথা প্রকাশ করেছে, যদিও এই সূত্র সেই অর্থে
বিশ্বের দরবারে পৌঁছয়নি। আচার্য ভরতের ব্যাখ্যায়
ভাব লৌকিক। লৌকিক ভাব যখন রসে পরিবর্তিত
হয় তখন আমরা আনন্দ পাই। রস অ-লৌকিক। লৌকিক ভাব অলৌকিক (অ-লৌকিক) রসে পরিবর্তিত হতে
গেলে প্রয়োজন বিভাব। এটাই ভরতের সূত্র। ভরতের
সূত্র সাহিত্য আর নাটকে সীমাবদ্ধ। তবু ধর্ম
বিষয়ে এই তত্ত্ব প্রয়োগ করলে মূর্তি পূজার সমর্থন মেলে। মানুষ ত্রিতাপ জ্বালায় কাতর। এই ত্রিতাপ জ্বালা লৌকিক। ত্রিতাপ জ্বালা মানুষের
মনের ভাবের সাথে সংযুক্ত। এই ভাব যখন অলৌকিক রসে পরিণত হয় তখন মানুষ আনন্দ লাভ করে। আনন্দ হলো
ঈশ্বরের বহিরঙ্গা প্রকাশের অংশ। এটাই ধর্মের
পথ। লৌকিক ভাব থেকে অলৌকিক রসে পরিবর্তিত হতে গেলে বিভাব অপরিহার্য। এই বিভাব কোনো প্রতীক নয়। বিভাব, লৌকিক আর অলৌকিক অবস্থার সংযোগের মাধ্যম।
হিন্দু ধর্মে তাই মূর্তি, মন্ত্র, ব্রতকথা, পুরান সব কিছুই বিভাব। ভরতের সূত্র ধর্মীয় শাস্ত্রে প্রয়োগ করলে কিছু সীমাবদ্ধতা
আছে। সাহিত্যে রস আর ধর্মীয় মার্গে রস এক নয়। ধর্ম সাধনায় ভক্তিরস গুরুত্বপুর্ণ। ভক্তিরস আচার্য ভরত সমর্থন করেন নি। কারণ তিনি বলেছেন ভক্তি শেখানো বিষয়। ভক্তি কে রস
পর্যায়ে ব্যাখ্যা করতে গেলে বুঝতে হবে রূপ গোস্বামীর (আ. 1470-1559) তত্ত্ব।
আচার্য ভরতের সূত্র
ষষ্ঠ শতাব্দীতে আচার্য ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে
রসতত্ত্বের সূত্রটি বিবৃত করেন। সূত্রটি হলো
- বিভাবানুভাব ব্যভিচারী। -সংযোগাদ - রসো নিষ্পত্তি। রস এই শব্দের কোনো ইংলিশ প্রতিশব্দ
নেই। তবে কাছা-কাছি প্রতিশব্দ হলো এস্থেটিক প্লেজার। অতুলচন্দ্র গুপ্ত তাঁর কাব্যজিজ্ঞাসা পুস্তকে বলেছেন
এই সূত্র পাশ্চাত্য সাহিত্যেও প্রয়োগ করা যায়।
যদিও পাশ্চাত্য সাহিত্য বিশ্লেষণের জন্য তত্ত্ব সৃষ্টি করেছেন এরিস্টটল। তিনি শিল্পতত্ত্বের ব্যাখ্যায় মাইমেসিস (অনুকরণ)
শব্দ নিয়ে এসেছেন। ট্রাজেডি বিশ্লেষণে বলেছেন
ক্যাথার্সিস তত্ত্ব। আচার্য ভরত সাহিত্য সম্পর্কে
অনুকৃতি শব্দ ব্যবহার করেছেন।
আচার্য ভরতের সূত্র অনুযায়ী নাটকের চরিত্র আর
পটভূমি আমাদের মনের ভাবের সাথে সংযুক্ত হয়ে রসে পরিণত হয়। তখন আমরা আনন্দ আস্বাদন করি।
ভাব লৌকিক। রস অ-লৌকিক।
আমাদের মনে 8 (Eight) টি স্থায়ী ভাব আছে। রতি, হাস, শোক, ক্রোধ,
উৎসাহ, ভয়, জুগুপ্সা বিস্ময়। শম নামক ভাব কে প্রথমে অস্থায়ী ভাব বলা হলেও পরে এই ভাবের
প্রাবল্য বিচার করে মূল ভাবে স্থান দেয়া হয়। তাই মূল ভাব হলো 9 টি। আর 33 টি অস্থায়ী
ভাব আছে। অস্থায়ীদের ওপর নাম সঞ্চারী বা ব্যভিচারী।
1.হর্ষ, 2.বিষাদ, 3. গ্লানি, 4. শঙ্কা, 5. আবেগ, 6. উদাসিনতা, 7. জড়তা, 8. চপলতা, 9. মদ, 10. শ্রম, 11. নির্বেদ, 12. অসূয়া, 13. আলস্য, 14. গর্ব , 15.স্মৃতি, 16. মতি, 17. ধৃতি, 18. সুপ্ত, 19. মরণ 20. ব্যধি, 21. নিদ্রা, 22. উগ্রতা, 23. উন্মাদ, 24. ত্রাস, 25. অমর্ষ, 26. বিরোধ, 27. অবহিত্থা, 28. অপস্মার, 29. দৈন্য, 30. বিতর্ক, 31. ঔৎসুক্য, 32. চিন্তা, 33. ব্রীড়া।
এই 33 অস্থায়ী ভাবের সাহে 33 কোটি
দেবতার একটা সংখ্যাগত সাদৃশ্য আছে। বিভাব আবার দু প্রকার। বিভাব আলম্বন। বিভাব উদ্দীপন।
বিভাব আলম্বন হলো নাটকের চরিত্র। আর বিভাব উদ্দীপন হলো নাটকের পরিবেশ। নাটকের চরিত্র,
তাদের অভিনয়, নাটকের পরিবেশ এগুলো আমাদের মনে স্থায়ী আর অস্থায় ভাবের সাথে যুক্ত হয়ে
রসে পরিণত হয়।
রতিভাব => শৃঙ্গার রস, শোকভাব => করুণ রস, হাসভাব => হাস্য রস, ভয়ভাব => ভয়ানক রস, ক্রোধভাব => রৌদ্র রস, উৎসাহভাব => বীর রস, বিস্ময়ভাব => অদ্ভুত রস, জুগুপ্সাভাব (ঘেন্যা)=> বীভৎস রস, শমভাব => শান্ত রস
রস আমাদের মনে আনন্দ জাগায়। নাটক মিথ্যে। তবু
আমরা নাটক বা সাহিত্য পড়লে তাতে ডুবে যাই। রসাস্বাদনে ডুবে যাই। একে বলে তন্ময়ীভবনযোগ্যতা।
নাটকের নট-নটী লৌকিক। দর্শক আর তাদের ভাব
লৌকিক। যার শাস্ত্রীয় নাম সামাজিক।
মূর্তি পুজোয় ভরতের সূত্র
এবং তার সীমাবদ্ধতা
ভরতের সূত্রকে সাহিত্যের বাইরে প্রয়োগ করা হয়নি। ধর্মীয় মার্গে প্রয়োগ করলে কিছু সীমাবদ্ধতা আসে। তবু আমরা যে মূর্তি পূজা করি বা পূজার উপাচার মেনে চলি, এগুলো ভরতের সূত্র দিয়ে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। মূর্তি বা ছবি হলো বিভাব আলম্বন। পূজার উপাচার, মন্ত্র, পাঁচালি হলো বিভাব উদ্দীপন। এই বিভাব আমাদের মনের সাথে সংযুক্ত হয়। আমাদের বাস্তব জগতের ত্রিতাপ জ্বালা সেই ভগবানের মূর্তি স্বরূপ বিভবের মধ্যে দিয়ে রস পর্যায় পৌঁছয়। আমরা আনন্দ পাই। আমরা মনে করি, আমাদের কষ্ট, বেদনা আমরা যেন ঈশ্বরকে জানাতে পারলুম। আমরা পূজার নাটকীয় আয়োজনের মধ্যে দিয়ে আমাদের মনের ভাবের সংযোগে রস নিস্পত্তি ঘটাতে পারি। রস অলৌকিক |
পূজা বা উপাসনার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ভক্তি। এই ভক্তিমার্গে আসে ঈশ্বর চিন্তার সার্থকতা। ভক্তি বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গেলে ভরতের সূত্রে সীমাবদ্ধতা এসে যায়। আচার্য ভরত এবং তৎকালীন টীকাকারদের মতে ভাব হলো আমাদের জন্মগত অনুভূতি। ভক্তি হলো শেখানো সাবজেক্ট। ভক্তি ট্রেনিং দিয়ে নিয়ে আসা হয়। সামাজিক সংস্কার হিসেবে মনে যুক্ত হয়। জন্মগত নয়। তাই ভক্তি মার্গের বিশ্লেষণে ভরতের সূত্র প্রয়োগ করা যায় না। ভক্তি কে রস পর্যায় বিচার করার প্রথম প্রয়াস করেন আচার্য মম্মট। আচার্য মম্মট কাব্যপ্রকাশ গ্রন্থে বলেছেন যে মানুষ গুরুজন বা দেব-দেবীদের প্রেম করে। সেই প্রেম স্বামী স্ত্রীর প্রেম নয়। সেই প্রেমের প্রকাশ অন্যরকম। তা স্বত্তেও গুরুজনদের প্রতি আমাদের যে প্রেম হয় সেই প্রেম সংস্কার থেকে এলেও, সেই প্রেমের ভাব এতো প্রবল থেকে যে আমাদের অলৌকিক রস পর্যায় নিয়ে যায়। ভক্তিরসের বীজ সেখান থেকে শুরু। ভক্তিরস পরে চৈতন্যদেবের হাত ধরে গৌড়ীয় বৈষ্ণব রসে বিকাশ লাভ করে। ভক্তি কে সম্পূর্ণ ভাবে আত্তীকরণ করতে হলে সাহায্য নিতে হবে রূপ গোস্বামীর (আ. ১৪৭০-১৫৫৯) উজ্জ্বলনীলমণি এবং ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থের। আর সেখান থেকেই চৈতন্যদেবের অবদান বোঝা যায়।
এই দুই গ্রন্থের ওপর সংক্ষিপ্ত টীকা উইকিপেডিয়ার
বাংলা সংস্করণ অনুযায়ী নিম্নরূপ -
উজ্জ্বলনীলমণি সংস্কৃতে রচিত বৈষ্ণবশাস্ত্রীয় গ্রন্থবিশেষ। রূপ গোস্বামী (আ.
1470-1559) প্রণীত বঙ্গীয় বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের দুটি প্রধান আকর গ্রন্থের একটি হলো উজ্জ্বলনীলমণি, অপরটি ভক্তিরসামৃতসিন্ধু। দ্বিতীয় গ্রন্থে ভক্তিরসের চরম রূপ মধুররস বা উজ্জ্বলরস (শৃঙ্গার) ব্যতীত অপরাপর প্রকারভেদ আলোচিত হয়েছে; আর পনেরোটি প্রকরণে বিভক্ত উজ্জ্বলনীলমণিতে আলোচিত হয়েছে মধুর রস। সেখানে একে বলা হয়েছে ভক্তিরসরাজ (ভক্তিরসের চূড়ান্ত রূপ)। বৈষ্ণব সম্প্রদায় মধুর রসকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তির চরম রূপ বলে মনে করেন।
মধুর রসের বিভাব হলেন কৃষ্ণ ও তাঁর প্রিয়তমাগণ, যাঁদের মধ্যে রাধা অগ্রগণ্যা। উজ্জ্বলনীলমণিতে রাধাকে বলা হয়েছে হ্লাদিনী মহাশক্তি। বৈষ্ণব রসশাস্ত্র মূলত ধর্মীয় দর্শন হলেও একাধারে তা সাহিত্যবিষয়কও বটে, যেহেতু এখানে ধর্মীয় স্থায়িভাব ভক্তি রসাস্বাদে পরিণতি লাভ করেছে এবং তাকে বলা হয়েছে ভক্তিরস। বৈষ্ণবপূর্ববর্তী সমালোচকরা ভক্তিভাবকে রসের মর্যাদা দেননি, কিন্তু বৈষ্ণব চিন্তানায়কগণ একে সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের নব্য সম্প্রদায়ের পারিভাষিক রসপর্যায়ে উন্নীত করেন। এভাবে রসবাদ অলঙ্কারশাস্ত্রে এক নতুন মাত্রা লাভ করে।
ভক্তিরস কে বুঝতে গেলে রাধা - কৃষ্ণ এই যুগল রূপ কে বুঝতে হবে। রাধা-কৃষ্ণ
কে বুঝতে গেলে আর রূপ গোস্বামীর তত্ত্বটির প্রয়োগ জানতে গেলে আমাদের জানতে হবে কৃষ্ণদাস
কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত।
চৈতন্যদেবের বিখ্যাত পরিকর নিত্যানন্দ তাঁর তরুণ ভক্ত বৃন্দাবন দাসকে
বাংলায় চৈতন্য ভাগবত লিখতে আদেশ দেন। বৃন্দাবন
দাসের বৃহৎ গ্রন্থ সমাপ্তির প্রায় ষাট বছর পরে কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্য চরিতামৃত নামে
চৈতন্য জীবনী ধারার সবচেয়ে পরিশীলিত গ্রন্থটি (1600-1612) রচনা করেন। চৈতন্য ভাগবত
ও চৈতন্য চরিতামৃত-এর মধ্যবর্তী সময়গুলিতে আরও অনেকগুলি কম প্রচারিত চরিতাখ্যান রচিত
হয়েছে। এগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কবি কর্ণপুরের সংস্কৃত গদ্য রচনা কৃষ্ণচৈতন্য
চরিতামৃতম মহাকাব্যম (রচনা 1582), এবং আরও অনেক পরের নাট্যকর্ম চৈতন্য চন্দ্রোদয় নাটকম
(রচনা 1572-79), লোচন দাসের বাংলা রচনা চৈতন্যমঙ্গল (রচনা 1570-1580) এবং জয়ানন্দের
জনপ্রিয় অথচ বিতর্কমূলক বাংলা আখ্যান যার শিরোনামও চৈতন্যমঙ্গল (রচনা 1550-60)।
রাধা-কৃষ্ণ এবং ভক্তি –ভুক্তি
ভুক্তি কথার অর্থ pleasure বা আনন্দ। ত্রিতাপ জ্বালায় কাতর মানুষ ধর্মের পথে
আনন্দলাভের চেষ্টা করে। এই আনন্দলাভ করতে গেলে মানুষের মনের যা ভাব বা অবস্থা যেমন
- ব্যথা, বেদনা, সুখ, ভয় ইত্যাদি সবকিছু
রস পর্যায় নিয়ে যেতে হয়। ভাব লৌকিক , রস অ-লৌকিক| আচার্য ভরতের সূত্র ধরে ভাব থেকে
রসে পৌঁছতে গেলে লাগে বিভাব। হিন্দুধর্মে
মূর্তি, ছবি, পুরাণের গল্প, ব্রতকথা এই সবকিছুই বিভাব। বিভাব আলম্বন আর বিভাব উদ্দীপন। ধর্ম আলোচনা
করলে রসের মধ্যে ভক্তিরস সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ।
আচার্য ভরত এবং পরবর্তী টীকাকাররা ভক্তি কে রস বলে মানেন নি। এখানেই সাহিত্যের সাথে ধর্মের পৃথকীকরণ। রসের
মধ্যে ধর্মীয় বিচারে ভক্তিরস সবথেকে প্রধান। ভক্তিরস বুঝতে গেলে জানতে হয় রূপ
গোস্বামী প্রণীত বঙ্গীয় বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের
দুটি প্রধান আকর গ্রন্থের একটি হলো উজ্জ্বলনীলমণি, অপরটি ভক্তিরসামৃতসিন্ধু।
হিন্দুধর্মে ভক্তির গুরুত্ব সমাজে প্রবলভাবে প্রচার করেন চৈতন্যদেব। চৈতন্যদেবের কথাতেই রূপ গোস্বামী এই রসতত্ত্ব
প্রচার করেন। চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে ভক্তিরস আর রাধা কৃষ্ণের শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণ
খুব প্রাঞ্জল ভাবে দেয়া আছে।
চৈতন্য চরিতামৃতে চতুর্থ অধ্যায়ে আছে "দোঁহার
যে সমরস ভরতমুনি মানেন আমার ব্রজের রস সেহ নাহি জানে।" এই শ্লোকের বিস্তারিত ব্যাখ্যা
করলে এটা বোঝা যায় যে - ভরতের সূত্র সাহিত্যে সীমাবদ্ধ। ব্রজের যে রস সে আরো বিস্তারিত। ব্রজের রসের মধ্যেই রয়েছে ভক্তি। ব্রজের রস বোঝাতে
রাধা কৃষ্ণ এই বিভাব আলম্বন কে নিয়ে আসা হয়েছে। দোঁহার কথার অর্থ দুজনের। যুগ্ম। দোঁহার যে সমরস বলতে এখানে দাম্পত্য প্রেমের
কথা বলা হচ্ছে। যাকে শাস্ত্রীয় বিচারে বলে
সমঞ্জসা রতি। যে রতিতে পুরুষ আর নারীর স্বার্থ
থাকে 5০%-5০% । এটাই ভরত মুনির কথিত রতি ভাব।
এই রতিতে অন্য পুরুষ বা নারীর প্রবেশে আসে ঈর্ষা, দ্বেষ। ব্রজের রস আরো গভীরের বিষয়। ব্রজ অর্থাৎ বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ রাধা আর গোপিনীদের
সাথে রাসলীলায় মত্ত। এখানে সবাই কৃষ্ণকে আলাদা
করে পাচ্ছে। কেউ অপরের ওপর ঈর্ষা করছে না। রাধার আনন্দ সবথেকে বেশি। এটাই ব্রজের রস। এই রসের মূলে রয়েছে ভক্তি আর সমর্পন। একটা গাছের মূল হলো কৃষ্ণ, আর রাধা-গোপিনী সবাই
শাখা প্রশাখা। গাছের গোড়ায় জল দিলে সবাই পুষ্টি লাভ করে। এই বিষয়টির শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা চৈতন্য চরিতামৃতের
মধ্যলীলায় রয়েছে। রাধা কে বলা হয়েছে মহাভাব স্বরূপিণী রাধা ঠাকুরানী। আর কৃষ্ণ হলো রসরাজ্। উজ্জ্বলনীলমণিতে
আলোচিত মধুর রস। সেখানে একে বলা হয়েছে ভক্তিরসরাজ (ভক্তিরসের চূড়ান্ত রূপ)। অর্থাৎ
রাধা হলো মহাভাব আর কৃষ্ণ হলো রসরাজ। ভাব লৌকিক। রস অলৌকিক| অর্থাৎ কৃষ্ণ অলৌকিক। কৃষ্ণ
অলৌকিক, তাই গোপিনীদের ঈর্ষা আসেনা। তাই বলাহয় ভক্তি তে আনন্দ বা ভক্তি থেকে আনন্দ। সমাস করলে ভক্তিভুক্তি |
ভাব ছাড়া যেহেতু রস
হয়না তাই রাধা ছাড়া কৃষ্ণ হয়না। আগে লৌকিক ভাব, সেখান থেকে অলৌকিক রস। তার থেকে আনন্দ।
তাই রাধা আগে কৃষ্ণ পরে।রাধা মহাভাব, কৃষ্ণ রসরাজ। চৈতন্য চরিতামৃত অনুযায়ী রাধা হলো
দেহ আর কৃষ্ণ হলো আত্মা। আদি হিন্দু দর্শন সাংখ্য অনুসারে পুরুষ আর প্রকৃতি। জীবাত্মা
আর পরমাত্মা। আধুনিক বিজ্ঞানেও এই অলৌকিক রসের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ঈশ্বর কণিকার ওপর এক্সপেরিমেন্ট সমস্ত বিশ্বে চর্চিত। ঈশ্বর কণা সবসময় ঘূর্ণায়মান। তবু তাকে চোখে দেখা যায় না। রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তি তাপ বিকিরণের তত্ত্ব কে
সমর্থন করে। কৃষ্ণ কালো। সমস্ত শক্তির আধার। কালো রং সব শক্তি শোষণ করে। সাদা রং সব শক্তি প্রতিফলিত করে। রাধা শুভ্র।
বৈষ্ণব
আর শাক্ত – সম্পর্ক
উজ্জ্বল নীলমণি গ্রন্থে গৌড়ীয় বৈষ্ণব রসের
অলৌকিকত্ব প্রকাশ পেয়েছে।
হিন্দুধর্মে আমরা দুজন দেবতার নাম
পাই। শ্রীকৃষ্ণ বা গোবিন্দ আর মহাদেব বা
শিব। গোবিন্দকে যারা ভজনা করে তাদের
বৈষ্ণব বলে। আর এক সম্প্রদায় শাক্ত নামে
প্রচলিত যারা শক্তির উপাসনা করে। শক্তির
উপাসনা বলতে শিব আর কালীর উপাসনাকে বোঝায়।
বর্তমান আলোচনায় দেখানো হয়েছে যে
বৈষ্ণব আর শাক্ত মূলত একই। একই
মুদ্রার দুই পিঠ। রূপ গোস্বামী বলেছেন যে
কৃষ্ণ হলো মধুর রস। তাই রসরাজ কৃষ্ণ হলো
মাধুর্য মূর্তি। মাধুর্য মূর্তি তে সাধক
নিজের আত্ম -উন্নয়ন করে। নিজের ব্যাক্তিগত
উন্নতি করে। নিজের মন কে পার্থিব যন্ত্রনা
থেকে অনেক উচ্চ স্তরে সৎ -চিৎ - আনন্দের সন্ধান করে। মাধুর্য মূর্তিতে কৃষ্ণকে বলাহয় ত্রিগুণাতীত। ত্রিগুন হলো -সত্ত্ব, তম, রজঃ। অর্থাৎ ত্রিগুণের অতীত। পক্ষান্তরে মহাদেব বা শিব হলো ত্রিগুণের
অধীশ্বর। সত্ত্ব, তম, রজঃ এই তিন গুন হলো
শিবের প্রকাশ। এই তত্ত্বের শাস্ত্রীয় সমর্থন হলো - ভাগবতের 10/88/3 (স্কন্ধ/ অধ্যায়/ শ্লোক)
শ্লোকের ভাষায় শিব অহংকার গুনের অধিকারী এবং শক্তির সঙ্গে যুক্ত শিবঃ শক্তিযুত
শশ্বৎ। অহংকার তিন প্রকার সাত্বিক, তামসিক, রাজসিক। সুতরাং শিব সত্ত্ব, তমঃ, রজঃ এই তিন গুন
বিশিষ্ট। শিব সবসময় শক্তির সাথে যুক্ত। শক্তি বলতে আমরা স্ত্রী দেবী কে বুঝি। তাই শিব আর কালী সবসময় সংযুক্ত। সংযুক্ত থাকার জন্য যুগ্ম পূজার প্রচলন নিষিদ্ধ। কারণ একজনকে পূজা করলেই আর এক জনের পূজা হয়ে
যায়। ট্রাই গুনের অধীশ্বর শিব হলো ঐশ্বর্য্য মূর্তি। অর্থাৎ কৃষ্ণ হলো মাধুর্য্য
মূর্তি আর শিব হলো ঐশ্বর্য্য মূর্তি। ঐশ্বর্য্য মূর্তির বৈশিষ্ট হলো পরোপকার
করা। সাধক ভক্তের উপকার করে। মাধুর্য্য মূর্তি আত্ম-চেতনা বাড়ায় আর
ঐশ্বর্য্য মূর্তি পরোপকার করে। সুতরাং শাস্ত্রীয় মতে পরোপকার করা মূলত ঈশ্বর
সাধনা। স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় শিব
জ্ঞানে জীব সেবা। আমরা পরোপকার করবো কারণ
পরোপকারে নিজেরই উপকার। স্বামী বিবেকানন্দ
তার প্রবন্ধে যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে কোনো গরিব কে অন্নদান করলে আসলে আমাদের ই
উপকার হয়। আমরা অন্নদান না করলেও পৃথিবী থেমে
থাকবে না, তবু আমাদের পরোপকার করা উচিত।
শিব পুজাতে শিবলিঙ্গ আর শিবের প্রতিমা এই দুইয়ের পূজার প্রচলন
আছে। মহাভারতে ব্যাসদেব অশ্বত্থামাকে
বলছেন যে - কৃষ্ণার্জুন শিবলিঙ্গের পুজো করেন আর অশ্বত্থামা শিব প্রতিমার পূজা
করেন। তাই কৃষ্ণার্জুন ভক্তের বিচারে
অশ্বত্থামার থেকে উচ্চ স্থানে আছেন।
ব্যাসদেব শিবলিঙ্গ আর প্রতিমা এই দুইয়ের পার্থক্য বর্ণনা করেননি। তবে পূজা
পদ্ধতি অনুসরণ করলে একটা পার্থক্য দেখা যায়।
নিত্যপূজা পদ্ধতিতে দেখাযায় শিবলিঙ্গ নিত্য পূজা করতে হয়। শিবলিঙ্গের বির্সজন হয় না। নিত্য গৃহে অধিষ্ঠান করে। প্রকারান্তরে প্রতিমার বিসর্জন হয়। তাই নিত্যপূজাকে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে আগে রাখা
হয়েছে।
প্রসঙ্গত একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার যে -
অতিলৌকিক বলে একটি শব্দ আছে । অতিলৌকিক কথার অর্থ হলো জাদু, ভোজবাজি। অতিলৌকিক আর অলৌকিক সম্পূর্ণ আলাদা
ব্যাপার। অলৌকিক হলো রস। লৌকিক ভাব মনের
মধ্যে গিয়ে অলৌকিক রসে পরিণত হয়। অলৌকিক রস আমাদের আনন্দ দেয়। অপরপক্ষে পরোপকারের নামে অনেক সময় সাধক,
ভোজবাজি বা জাদু এই সব চমক দেওয়া পন্থা
অনুসরণ কোরে ভক্তদের বশ করে। এই অতিলৌকিক
ব্যাপারটি ধর্ম আলোচনার শাস্ত্রীয় পথ নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন বিষ্ঠা। অতিলৌকিক ব্যাপারটি বিজ্ঞান সমর্থিত নয়। তবে তন্ত্রে অতিলৌকিক ব্যাপারে কিছু শাস্ত্রীয়
সমর্থন আছে কিনা সেটা লেখকের অজ্ঞাত।
উপসংহার
স্বামী বিবেকানন্দ চিকাগো ধর্ম মহাসভায় ভারতীয় দর্শন আর ঐতিহ্য কে বিশ্বের
দরবারে তুলে ধরেছিলেন। ভারতীয় দর্শনের দুটি বিশ্বমানের তত্ত্ব আচার্য ভরতের সূত্র আর
রূপ গোস্বামীর রসতত্ত্ব স্বামী বিবেকানন্দ চর্চা করেননি। তিনি মূলত উপনিষদের তত্ত্বকে
প্রতিষ্ঠা করেন। আধুনিক যুগে বাঙালির উচিত ভরত আর রূপ গোস্বামীকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে
আসা।
No comments:
Post a Comment