বঙ্কিমচন্দ্রের চন্দ্রশেখর
বঙ্কিমচন্দ্রের চন্দ্রশেখর
আর রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি এই দুই
উপন্যাস হলো বাংলা সাহিত্যের দুই যুগান্তকারী সৃষ্টি। বঙ্কিমচন্দ্র 1877 সালে চন্দ্রশেখর লিখেছিনেন।
চন্দ্রশেখর উপন্যাসের সামাজিক প্রেক্ষাপট বাংলার শেষ নবাব মীরকাসেমের সময়কাল। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানির জমানা। বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে
পরিবর্তিত হওয়ার প্রাক মুহূর্ত। সেখানে চন্দ্রশেখর, শৈবলিনী আর প্রতাপ এই ত্রিমুখী সমীকরণ। এই উপন্যাসে রমানন্দ স্বামীর স্বগতোক্তি, “আমি
এতকাল সর্বশাস্ত্র অধ্যয়ন করিলাম, সর্বপ্রকার মনুষ্যের সহিত আলাপ করিলাম, কিন্তু
সকলই বৃথা! এই বালিকার মনের কথা বুঝিতে পারিলাম না! এ সমুদ্রের কি তল নাই?” গভীর ভাবে বিচার করলে এই উক্তি বিশ্বের দরবারে
বঙ্কিমচন্দের এক অগ্রগণ্য অবদান। যে অবদানের স্বীকৃতি তিনি কোনোদিনই পাননি। প্রকারান্তরে
রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি সেই অবদানেরই প্রতিচ্ছবি।
কালজয়ী এই দুই উপন্যাস বুঝতে গেলে প্রথমে জানতে হবে ফ্রয়েডের তত্ত্ব আর
এই দুই উপন্যাস রচনার সময়কাল। ফ্রয়েড তাঁর যুগান্তকারী
মনস্তত্ব আবিষ্কার করেন 1881 থেকে 1900 সালের মধ্যে। ফ্রয়েডের মনস্তত্ব বিচার করে দেখলে চন্দ্রশেখর
উপন্যাসের চরিত্র আর ঘটনা গুলো ফুটে উঠেছে সাইকোলজির পথ ধরে। সেই
হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্বের দরবারে প্রথম নিয়ে এলেন মনস্তত্বের জটিল সমীকরণ। ফ্রয়েডের আগে। রবীন্দ্রনাথ যখন চোখের বালি লিখেছেন তখন
ফ্রয়েডের তত্ত্ব বিশ্বে প্রচারিত। সেই হিসেবে রবীন্দ্রনাথ চরিত্র
এঁকেছেন সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় পথ ধরে।
ফ্রয়েডের সাইকোলজি তত্ত্বের কিছু বিশেষ টার্মিনোলজি হলো ইড, ইগো, সুপার ইগো, লিবিডো। ফ্রয়েডের মডেল অনুযায়ী ইড হলো কিছু অসংগঠিত
সেক্স বিষয়ক ইচ্ছা। প্রকারন্তরে সুসংগঠিত এবং
বাস্তব সম্মত ইচ্ছা হলো ইগো। সুপার ইগো সেখানে আরো আধুনিক
এবং জটিল সমীকরণের ফলাফল। ইগো হলো ইড আর সুপার ইগোর
মধ্যস্থতাকারী এক প্রকার চিন্তা। মানুষের ইড যা করতে চায় সুপার
ইগো তাকে থামিয়ে দেয়। লিবিডো আবার প্রবল যৌন-ইচ্ছা কে প্রকাশ করে। লিবিডো মৃত্যু -
ইচ্ছাকেও হাতছানি দেয়। Acording to Wikipedia: Id, ego,
and super-ego are the three parts of the psychic apparatus defined
in Sigmund Freud's structural model of the psyche; they are the three theoretical constructs in
terms of whose activity and interaction our mental life is described. According
to this model of the psyche, the id is the set of uncoordinated
instinctual trends; the super-ego plays the critical and moralizing
role; and the ego is the organized, realistic part that
mediates between the desires of the id and the super-ego.[1] The super-ego can stop one from doing certain things
that one's id may want to do.
চন্দ্রশেখরের ষষ্ঠ খন্ডের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে যোগবল না Psychic Force? শীর্ষক
অধ্যায়ে শৈবলিনীর যে প্রশ্নোত্তর পর্ব রয়েছে সেখানে এই মনস্তত্ত্ব প্রাঞ্জল হয়ে ফুটে
উঠেছে। কিছু কথোপকথন বিচার করলে দেখা যাবে - জটিল মনস্তত্ত্ব ফুটে ওঠে।
শৈ। আমি পাগল হইয়াছি। (এখানে শৈলবালা ইড)
শৈ। এখন এ যে স্বপ্ন—আপনার গুণে জ্ঞানলাভ করিয়াছি। (এখানে শৈলবালা ইভ থেকে সুপারইগো স্টেটে পৌছচ্ছে। চন্দ্রশেখর সুপার ইগো।)
চ। তুমি ফষ্টরের সঙ্গে গেলে কেন?
শৈ। প্রতাপের জন্য।
চন্দ্রশেখর চমকিয়া উঠিলেন—সহস্রচক্ষে বিগত ঘটনাসকল পুনর্দৃষ্টি করিতে লাগিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “প্রতাপ কি তোমার জার?”
শৈ। ছি! ছি! (এটা ইগো, চন্দ্রশেখর
উপন্যাসে প্রতাপের চরিত্র ইগো অবস্থাকে ফুটিয়ে তোলে।)
চ। বাসমাত্র—তবে কি তুমি সাধ্বী?
শৈ। প্রতাপকে মনে মনে আত্মসমর্পণ করিয়াছিলাম—এজন্য আমি সাধ্বী নহি—মহাপাপিষ্ঠা।
চ। নচেৎ?
চ। নচেৎ?
শৈ। নচেৎ সম্পূর্ণ সতী।
চ। ফষ্টর সম্বন্ধে?
শৈ। কায়মনোবাক্যে।
চন্দ্রশেখর উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র যে অসামান্য মনস্তত্ব সৃষ্টি করে
গেছেন তার স্বীকৃতি তিনি কোনোদিনই পাবেন না। আমরা ফ্রয়েড পড়বো। শুধু
বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান জানতে পারবো না।
রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি ফ্রয়েডের পরবর্তী পর্যায়ের লেখা। চোখের
বালিতে রবীন্দ্রনাথ লিবিডো নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের
চন্দ্রশেখরে লিবিডো নিয়ে বিশেষ প্রভাব দেখা যায় না। হয়তো প্রেক্ষাপট। কারণ
১৭৬৪ সালের প্রেক্ষাপটে প্রেমের সাইকোলজিকাল সমীকরণে লিবিডো নিয়ে আসা একটু কঠিন
কাজ। প্রকারান্তরে রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন বঙ্গসমাজে লিবিডো আর সেক্স ড্রাইভ নিয়ে
চোখের বালিতে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন।
উইকিপিডিয়া অনুযায়ী দ্য
বেঙ্গলি পত্রিকার ১৯০১ সালের ১৮ এপ্রিল ও ২৯ এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিতব্য নবপর্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকার গ্রাহকভুক্তির জন্য একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল। এই বিজ্ঞাপনে ছিল, "A highly interesting novel by
Babu Ravindranath Tagore, will appear from the first month."] ১৯০১ সালের ১৫ মে নবপর্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রথম কিস্তিতে চোখের বালি উপন্যাসের প্রথম চারটি পরিচ্ছেদ মুদ্রিত হয়। শেষ কিস্তিটি প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালের ২১ অক্টোবর। সুকুমার সেনের মতে উপন্যাসের বিষয় "সমাজ ও যুগযুগান্তরাগত সংস্কারের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের বিরোধ" । ১৯০৩ সালের ৫ এপ্রিল উপন্যাসটি কলকাতার মজুমদার লাইব্রেরি বই আকারে প্রকাশিত হয়। ক্রাউন ৮ পেজি ৩৩৮ পৃষ্ঠায় বইটি মুদ্রিত হয়। মুদ্রণের সংখ্যা ছিল ১০০০। দাম ছিল ২ টাকা চার আনা। বই আকারে প্রকাশের সময় লেখক সাময়িকপত্রে প্রকাশিত কোনো কোনো অংশ বর্জন করেছিলেন। ১৯১০ সালের ২০ জুন ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস চোখের বালি উপন্যাসের নতুন সংস্করণ প্রকাশ করে। চোখের বালির
সারমর্ম ফ্রয়েডের মনস্তত্বকে বহন করে। চোখের বালি
উপনাস্যে রবীন্দ্রনাথ ফ্রয়েডের
ইড, ইগো, সুপার ইগো,
এই চরিতের সাথে
লিবিডো অবস্থাকেও ফুটিয়ে
তুলতে চেষ্টা করেছেন।
No comments:
Post a Comment