পথের পাঁচালী ভারতীয় সাহিত্যে এক যুগান্তকারী
উপন্যাস। রঞ্জন প্রকাশলয় থেকে (BY 1336) ১৯২৯
সালে ২৫৬ পাতার উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকারান্তরে তাঁর লেখা চাঁদের পাহাড় (১৯৩৭)
একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মী কিশোর সাহিত্য।
চাঁদের পাহাড় থেকে বিভূতিভূষণ সম্পর্কে
কিছু তথ্য অনুমান করা যায়। যেমন তিনি
জ্যোতিষ শাস্ত্রে আর হোমিওপ্যাথি ওষুধে বিশ্বাসী ছিলেন। মানচিত্র সম্পর্কেও তাঁর জ্ঞান ছিল প্রবল। এই অনুমান
থেকে পথের পাঁচালী সম্পর্কে কোনো সরাসরি যোগসূত্র নেই তবে মানুষের সাইকোলজি বিষয়ে ওনার
এপ্রোচ অনেক লেখকের থেকে স্বতন্ত্র। এই বিশ্লেষণী
ক্ষমতা পথের পাঁচালীতে অপুর চরিত্র চিত্রণে
এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। আর সেই মাত্রা
ধরেই পথের পাঁচালীতে দুটি ভিন্ন মত পাশ্চাত্য ক্যাথার্সিস তত্ত্ব আর প্রাচ্য শ্রীমদ্ভাগবত
গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ের তত্ত্ব একত্রীভূত হয়েছে। এই বিরল সংযোগের কৃতিত্ব বিভূতিভূষণ
বন্ধ্যোপাধ্যায় হয়তো কোনোদিন পাবেন না। তবু তাঁর তত্বটি পাশ্চাত্য সাহিত্যে রপ্তানি
যোগ্য বিষয়। পথের পাঁচালীর কাব্য বিন্যাস আলোচনা করার আগে এই প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য
তত্ত্বের ওপর আলোকপাত করা যাক।
আলেকজান্ডারের গৃহশিক্ষক এরিস্টটল
পোয়েটিক্স বলে একটি বই লিখেছিলেন। সেই
বইতে তিনি সাহিত্য বিচার করার কিছু তত্ত্ব দিয়েছেন। তিনি সেখানে ট্রাজেডি সাহিত্য সমালোচনা করার যে
সূত্র দিয়েছেন সেটা ক্যাথার্সিস। সেহানে দেখাযায় ট্রাজিক হিরোদের অনেক সদ্গুণ
থাকে। তারা নাটকে উচ্চ পর্যায় ওঠে। একটা
স্তরের পর তাদের নিজস্ব কোনো চারিত্রিক দোষের জন্য পতন হয়। এই তত্ত্ব
শেক্সপীয়ার থেকে প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণ মহাভারত সর্বত্র প্রযোজ্য। যেমন রামায়ণে মেঘনাদ, মহাভারতে কর্ণ। ট্রাজেডি চরিত্র সব বয়সের মানুষের মনে আলাদা
আলাদা প্রভাব আনে। শিশুমনে এই চরিত্র
বিশেষ প্রভাব ফেলে। শিশুমন এই সমস্ত চরিত্র থেকে শিক্ষা লাভ করে। মানুষের এই শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে প্রাচ্য
দর্শন আর আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনে আলাদা মতবাদ প্রকাশ পেয়েছে। শ্রীমদ্ভগবতগীতায়
আছে উর্দ্ধমূলম অধশাখম অশ্বত্থ প্রাহুরব্ব্য়ম। অশ্বত্থ গাছের সাথে হিন্দু দর্শনের
একটা সংযোগ আছে। মানুষ কি করে শেখে তার সাথে জীবাত্মা আর পরমাত্মার যে সংযোগ সেটা
অশ্বত্থ গাছ দেখিয়েছে। মানুষের শিক্ষা পদ্ধতির ওপর পাশ্চাত্য দার্শনিক অন্যরকম মতামত দিয়েছেন। লক, হিউম,
বার্কলে এনারা বলেছেন মানুষ বুদ্ধি দিয়ে শেখে। লিবনিজ, দেকার্তে, স্পিনোজা এনারা
বলেছেন মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়ে শেখে। এমানুয়েল কান্ট্ বলেছেন মানুষ অভিজ্ঞতা পূর্ব
একটা শক্তি দিয়ে শেখে। যেটাকে বলে আপ্রায়রি।
বিভূতিভূষণ এই দুই মতবাদের মধ্যে একটা সংযোগ
স্থাপনের সৃষ্টি করেছেন। তিনি
দেখিয়েছেন সাহিত্যে মূলত ট্রাজিক চরিত্র
শিশু মনে গভীর প্রভাব ফেলে। যেমন অপুর মনে কর্ণ। অপু তীর ধনুক খেলছে। কর্ণ অর্জুনের যুদ্ধে যতগুলো তীর মারলে অপুর মন
আনন্দ পায়, অপু সেটাই করছে। অপুর শিশুমনে
ট্রাজেডির অভিজ্ঞতা নেই। বুদ্ধি দিয়েও
শিশুমন ট্রাজেডি বুঝতে পারবে না। তবু
গল্পের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে অপু এটা অনুভব করতে পারবে যে কোনটা ভালো আর কোনটা
মন্দ। দুর্গা -অপুর দিদি আবার পিসি ইন্দির
ঠাক্রুণের ভক্ত। ইন্দির ঠাকরুন উপন্যাসের
পটভূমিতে একজন বাস্তব চরিত্র। লেখন এই চরিত্রগুলো
যেভাবে সাজিয়েছেন সেখানেই লেখকের সার্থকতা। তিনি দেখিয়েছেন একজন সরল শিশুমন কিভাবে বড়ো
হয়। এখানে বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতা
পূর্ব আপ্রায়রি এই সমস্ত বিষয় ফুটে উঠেছে।
সেই সাথে লেখক এটাও দেখিয়েছেন শিশুমনে সাহিত্যের প্রভাব। বিশেষ করে ট্রাজিক হিরো। শিশুমনে সাহিত্যের প্রভাব -এই বিষয়ে সরাসরি কোনো দার্শনিক মতামত দেননি। বিভূতিভূষণ ঘটনা বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে সেই
মতামত দিয়ে গেছেন। বল্লালী-বালাই আর আম-আঁটির ভেঁপু এই দুই পর্বে লেখন শিশুমনের
জন্ম থেকে পরিণতি দেখিয়েছেন। আম আঁটি - এটা বীজ, মানে প্রাণের সূত্রপাত। সেই আঁটির
ভেঁপু। মানে তাকে ঘষে মেজে পরিণতি
দেওয়া। আর সূচনার বল্লালী বালাই দেখিয়েছে
সেই সময় সমাজে মেয়েদের যন্ত্রণার কথা। এটি
বাস্তব। উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে সমাজের
বাস্তৱ ট্রাজেডি। সেখান থেকে অপু আর
দুর্গা কি করে শিখছে, বড়ো হচ্ছে সেটা পথের পাঁচালীর বৈচিত্র্য।
পথের
পাঁচালীর সাথে দুজন প্রবাদ প্রতিম বাঙালি ব্যক্তিত্বের নাম জুড়ে আছে। একজন বন্দনীয়
ভাষা ভূষণের বিভূতি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আর এক জন সত্যজিৎ রায়। পথের
পাঁচালীর যাত্রা পথ শুরু হয়েছে 1929 সাল থেকে। সেই যাত্রাপথ সবাক চিত্রকাব্য হয়েছে
1955 সালে । ভাষা চিত্র আর চিত্র কাব্য দু জায়গাতেই আসল উদ্দেশ্য আনন্দ দেওয়া। যে
আনন্দ আসে মনের কোনে লুকিয়ে থাকা হৃদয় নিসৃত জারক রসের সাথে ভাবের সম্ভোগ। ভাষা
কাব্যে পথের পাঁচালী আর চিত্রকাব্যে পথের পাঁচালী এর মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য
হলো - দুর্গার রেলগাড়ি দেখা | বিভূতিভূষণ এর দুর্গা রেলগাড়ি দেখেনি। সত্যজিৎ রায় দুর্গাকে
রেলগাড়ি দেখিয়েছেন। পথের পাঁচালী পড়লে বা সিনেমা দেখলে চোখে জল আসে। এই জল বাস্তবের
চোখের জলের থেকে আলাদা। কাব্যে যখন চোখে জল আসে তখন পাঠক আনন্দ পায়। দুঃখতে চোখে
জল পড়ার যে আনন্দ সেটা কাব্যে হয়। এই আনন্দ, আমাদের মনের নয় টি স্থায়ী ভাব আর
তেত্রিশ টি অস্থায়ী ভাবের নির্যাস থেকে রস
নিস্পত্তি ঘটিয়ে আসে। বিভূতিভূষণের দুর্গা
রেলগাড়ি দেখেনি। এই অতৃপ্তিতে যে বিষাদ এর সুর, এটা মনকে গভীর ভাবে ছুয়ে যায়।
ট্রাজেডি আমাদের মন কে বেশি আকর্ষণ করে। কারণ এতে অন্তরের লুকিয়ে থাকা অতৃপ্তি, যে
রসাস্বাদন ঘটায়, তাতে বাস্তবের যন্ত্রণা ভুলে মানুষ্ ক্ষণিক এর জন্য দুঃখে চোখে জল
ফেলে। সেই জলে আনন্দ পাওয়া, এই প্রসঙ্গে
এরিস্টটলের ক্যাথার্সিস তত্ত্ব উল্লেখ করা যায়। ক্যাথার্সিস হলো ড্রামাটিক আর্টের
একটা প্রকাশ যেটা ট্রাজেডি কে বর্ণনা করে।সত্যজিত রায়ের দুর্গা রেলগাড়ি দেখেছে। বৃষ্টি ভেজা উচ্ছল মেয়েটা যখন রোগ সজ্জায় শেষ
নিশ্বাস এর প্রহর গুনছে, সেই দৃশ্যপট দর্শক এর চোখে জল এনে দেয়। সিনেমা এটাই বোধ
হয় ক্যাথার্সিসের এর সার্থক প্রয়োগ।
পথের
পাঁচালীর শেষ পর্যায় অপু রেলগাড়ি করে যাচ্ছে।
অপু নিজেকে বলছে - দিদি তোর সাথে আর রেলগাড়ি চড়া হোলোনা। ভাষা বিন্যাসে এই যে pathos এটা সিনেমার থেকে
অনেক ওপরে। লেখক যে বেদনের ভাষা ফুটিয়েছেন
সেটা উপন্যাস না পড়লে বোঝা যায় না। সিনেমা
দেখলে যে অনুভূতি আসে সেটার থেকে এই ভাষা বাহন শিল্পের প্রভাব আরো গভীর। একটা শিশুমনের পরিণতি, তার জীবনের ট্রাজেডি,
দিদির স্মৃতি, সাহিত্য থেকে বাস্তবের কত পার্থক্য -সেটা বোঝা, বল্লালী বালাই থেকে নারীজীবনের যে যন্ত্রনা শুরু সেই অনুভূতি, আবার ট্রেন,
কৃষি থেকে শিল্পের দিকে পরিবর্তন, ট্রেনে চড়ে আবার অনির্দেশের পথে যাত্রা - এই ‘অক্রুর
সংবাদ’ ভাষা বাহন শিল্পকে সিনেমার থেকেও
অনেক ওপরে নিয়ে গেছে। যদিও সেই স্বীকৃতি
বিভূতিভূষণ পাননি। পথের পাঁচালী
আন্তর্জাতিক স্তরে এক নতুন পথের দিশারী।
No comments:
Post a Comment