অবতার কথার অর্থ হলো "জীবদেহধারী ঈশ্বর বা দেবতা"| অবতার বলতে আমাদের মনে যে ধারণাটা আসে সেটা হলো - স্বর্গ বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে কিছু হাত পা যুক্ত দেবতা ঘুরে বেড়ান। সেই দেবতা এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। বৈদিক সাহিত্যে অবতার শব্দটি পাওয়া যায় না। তবে বেদ-পরবর্তী সাহিত্যে এটি ক্রিয়াপদ আকারে উল্লিখিত হয়েছে। মূলত খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর পরে রচিত পৌরাণিক সাহিত্যেই এই শব্দটিকে স্বতন্ত্রভাবে বিশেষ্য পদের আকারে ব্যবহার করা হয়েছে। অবতার বলতেই
আমাদের মনে ভগবান
বিষ্ণুর দশাবতার কথাটি
মনে আসে। মহাভারতে কৃষ্ণকে
বলাহয় বিষ্ণুর অবতার। মহাভারতে আর
একটি চরিত্র হলো
যুধিষ্ঠির। যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র। কিন্তু অবতার
নন। যুধিষ্ঠির রূঢ়ি শব্দ| ব্যাকরণগত ভাবে রূঢ়ি
শব্দ বলে একটি বিশেষ প্রকার শব্দ আছে।
যেমন পঙ্কজ। পাঁকে জন্মালেই সে
পঙ্কজ নয়। পঙ্কজ মানে পদ্মফুল। মহাভারতে যুধিষ্ঠির সেইরকম রূঢ়ি শব্দ। যুদ্ধে স্থির।
তাই যুধিষ্ঠির। অলুক অধিকরণে উপপদ
তৎপুরুষ। যুধিষ্ঠির যুদ্ধে স্থির হলেও
চিন্তাশীলতায় স্থির নয়। জুয়া খেলায় আসক্ত। নিজের স্ত্রীকেও বাজি রাখছেন। যুধিষ্ঠির
ধর্মপুত্র হলেও শ্রেষ্ঠ মানুষ বলা যায় না। মহাভারতে কৃষ্ণ অবতার। ব্যুৎপত্তি গত
ভাবে কৃষ্ণ কথাটি কৃষ থেকে এসেছে। কৃষ
মানে চাষবাস করা। কৃষ্ণ কৃষকাজের সাথে
যুক্ত। গরু পালন করতো। মহাভারতদের
প্রেক্ষাপটে শ্রীকৃষ্ণ অবতার। শ্রীমদ্ভগবতগীতায় যদা যদা হয় ধর্মস্য।...শ্লোকে
অবতার কথার উল্লেখ না থাকলেও অবতারের উপযোগিতার সমর্থন মেলে। বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণচরিত প্রবন্ধে দেখানোর চেষ্টা
করেছেন যে কৃষ্ণ কোনো মহাপুরুষ নয়। তবে
সেই যুগের অনুপাতে অত্যন্ত প্রগতিশীল মানুষ।
মধ্যযুগে
চৈতন্যদেব আর আধুনিক যুগে শ্রী রামকৃষ্ণদেব অবতার বলে অবিহিত। ভক্তরা শ্রী রামকৃষ্ণকে অবতার বরিষ্ঠ
বলেছেন। অবতার কথাটি শাস্ত্রীয় ভাবে বিচার
করলে, অবতারের যে ডেফিনেশন দেয়া আছে এই পথে এগোতে হবে। অবতার, সাধারণ মানুষ হয়ে জন্মালেও তাঁর মধ্যে
এমন বিশেষ কিছু গুন থাকবে যা দুষ্কৃতীদের থেকে সাধুদের উদ্ধার করে ধর্ম সংস্থাপন
করবে, সাধারণভাৰ মানুষের চোখে সহজে ধরা
পড়বে না, শুধু ভক্তরা লক্ষণ দেখে বিচার করবেন যে তিনি সাধারণ মানুষ নন। চৈতন্যদেব
আর শ্রী রামকৃষ্ণ সেই অর্থে সাধারণ মানুষ। তাঁদের ক্রিয়া কলাপ তৎকালীন মানুষের
কাছে অপাত ভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ লেগেছিলো।
ভক্তদের কাছে তাঁদের বিশেষ ক্ষমতা বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে।
সেই হিসেবে এনারা অবতার। অবতার সাধারণ মানুষ। শুধু তাঁদের মধ্যে এমন কিছু গুণ থাকে যার জন্য
সমকালীন মানুষের থেকে তারা অনেক যুগ এগিয়ে থাকেন। অবতারের এই বৈশিষ্ঠ্য চৈতন্য
চরিতামৃতের মধ্যলীলার শ্লোকে পরিষ্কার ভাবে বলা আছে।
"অবতার নাহি কহে আমি অবতার। মুনি সব জানি
করে লক্ষণ বিচার।"
"সৃষ্টি হেতু যেই মূর্তি প্রপঞ্চে অবতরে,
সেই ঈশ্বর মূর্তি অবতার নাম ধরে।"
ঈশ্বরত্ব হলো মানুষের এমন একটা ক্ষমতা বা গুন্ যাতে মানুষের মন লোভ
লালসার ওপর পতিত হলেও লিপ্ত হয় না| প্রসঙ্গত ভাগবতের প্রথমস্কন্ধে তৃতীয়
অধ্যায়ে অবতারের কথা বলা হয়েছে। বিশ্ব কার্যের নিমিত্ত অবতার আবির্ভূত হন।
যমুনাচার্য স্তোত্রে 18 নং শ্লোকে (মায়াবলেন ভবতাপি। ....) আছে অবতার মায়াবলের
দ্বারা নিজেকে গোপন করে রাখে। যারা ভক্ত, অবিরত ঈশ্বরের ধান করে, তারা অবতারের
স্বরূপ অনুভব করে।
রামকৃষ্ণদেব যখন কর্মজীবনে আসেন তখন হিন্দু সমাজে
নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়িয়ে রয়েছে। মূর্তিপূজা নিয়ে প্রচুর কুসংস্কার সমাজকে গ্রাস
করে ছিল। খৃস্টান মিশনারিরা হিন্দুদের নিচু চোখে দেখতেন আর হিদেন, প্যাগান ইত্যাদি
বলতেন। ডিরোজিওর প্রভাবে অনেকে খৃস্টান হয়ে গেছিলো। ভারতে রেনেসাসের প্রতীক রাজা রামমোহন রায়
ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এতে ধর্মীয়
গোড়ামি আর কুসংস্কার হয়তো মুছেছিলো তবু প্রকৃত হিন্দু দর্শনের সঠিক মূল্যায়ন
হলোনা। সেই সময় রামকৃষ্ণদেব এসে শোনালেন - যত মত তত পথ। এতবড়ো দর্শন আর কোনো
মহাপুরুষ বলেছেন কিনা সন্দেহ। মা কালীর
প্রতি তাঁর মাতৃভাবে সাধনা মূর্তি পুজোতে শাস্ত্রীয় ভাবনার বাস্তব প্রয়োগ
প্রদর্শিত হলো। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর
ভাষণে এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। স্বামীজী
যে, রামকৃষ্ণদেবের এই মূর্তিকে মাতৃ জ্ঞানে ভালোবাসার দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন সেটা
পরিষ্কার ভাবে লেখা আছে। অধ্যাত্ম জীবনে রামকৃষ্ণদেব তোতাপুরীর কাছে পুরী মন্ত্রে
দীক্ষা নেন। পুরী হলো শঙ্করাচার্যের
দশনামী সম্প্রদায়ের এক সম্প্রদায়। চৈতন্যদেব প্রথমে পুরী পরে ভারতী মন্ত্রে
দীক্ষিত। রামকৃষ্ণদেব এবং শ্রীচৈতন্যদেব
দুজনেই কঠোর ভাবে সন্ন্যাস ধর্ম মানেননি। ব্রহ্মবৈবর্ত্যবচনম কৃষ্ণ জন্মখন্ডে ১০৫/১৮০ উক্তি অনুযায়ী কলিকালে
অস্যার্থ, সন্ন্যাস বর্জ্য। হয়তো সেটাই
ফুটে উঠেছে রামকৃষ্ণদেব আর চৈতন্যদেবের মধ্যে।
প্রশ্ন আস্তে পারে, রামকৃষদেব কি সত্যি মা কালীকে
দেখতেন? উত্তর হলো, হ্যা দেখতেন। রামকৃষ্ণদেব যে মা কালীকে দেখতেন সেটা বিজ্ঞান
দিয়ে কি সমর্থন করা যায়? উত্তর হলো বিজ্ঞান দিয়ে না হলেও দর্শন (ফিলোজফি) দিয়ে
সমর্থন করা যায়। রামকৃষ্ণদেবের মা কালীকে দর্শনের নাম অ-পরোক্ষ দর্শন। আচার্য
ভরতের সূত্র প্রয়োগ করলে ব্যাপারটা হলো - রামকৃষ্ণদেবের মনের মাতৃভাব, বিভাব
আলম্বন মা কালীর মূর্তির মধ্যে দিয়ে রস পর্যায় পৌচচ্ছে। রস অ-লৌকিক। রামকৃষ্ণদেব
যেন মা কালীকে দেখছেন। এটাই হলো অ-পরোক্ষ দর্শন। সেই হিসেবে মূর্তি বা পুতুল পুজো
না করলে কখনোই রসপর্যায় পৌঁছনো যাবে না। তাই মা কালীকে দেখতে গেলে পুতুল পুজো
চাই-ই চাই| চৈতন্যদেবের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু কোনো রকম। আচার্য ভরত তাঁর
নাট্যশাস্ত্রে যে ভালোবাসার কথা বলেছেন সেটাকে শাস্ত্রীয় ভাষায় বলে
উজ্জ্বল-বেসাত্মক। যেখানে নায়ক আর নায়িকা
দুজনেই সমান সুখ উপভোগ করে। এটাই হলো
সাধারণ মানুষের ভালোবাসা, রতি বা কাম। বৃন্দাবনের রাধা যে কৃষ্ণকে ভালোবাসতেন সেটা
রাগাত্মিকা। রাগাত্মিকা রতিতে নায়িকা মানে
রাধার সুখ বংহীয়স (অধিকতর)। রাধা হলো বৃন্দারক (মুখ্য)| কোনো কোনো বৈষ্ণব
সাহিত্যকারের বিচারে চৈতন্যদেব রাধার কিভাবে অধিক সুখ হয় সেটা অনুধাবন করতে অবতার
হিসেবে এসেছিলেন। আর এক প্রকার ভক্তির কথা আছে সেটা হলো রাগানুগা। চৈতন্যদেবের
নির্দেশে রুপগোস্বামী উজ্জ্বলনীলমণি গ্রন্থে এই ভক্তির কথা বলেছেন। এখানে নায়িকা,
নায়কের সুখের জন্য সব সুখ বিসর্জন দিয়েছে|
ভগবান সম্পর্কে শ্রী রামকৃষ্ণদেবের কিছু কথা ইংলিশে লিখলে -According to the book "Ramakrishna" by Prof Max Muller, the
clarification given by Shri Ramakrishna on God & Soul is very simple. God
is one who tells a thief to steal and simultaneously alert the house owner
against theft. Soul is like the plug in syringe. Soul remains in body but not
its parts. Correlation of soul and god is like a pot kept inside water, where
water remains both inside ad outside of the pot. Importance of god in human
being is like the oil in lamp, without which lamp cannot be enlightened. To
reach the god, proper training is required, similar to the trained person can
catch and play with poisonous snake.
চৈতন্যদেবের জীবনী নিয়ে মূলত চারখানি গ্রন্থ
লিখিত হয়েছে। বাংলাপিডিয়া অনুসারে: সংস্কৃতে রচিত প্রথম জীবনীগ্রন্থ
চৈতন্যচরিতামৃত। এর রচয়িতা মুরারি গুপ্ত ছিলেন চৈতন্যদেবের সতীর্থ। গ্রন্থখানি
গদ্য-পদ্যের মিশ্রণে ‘কড়চা’ বা ডায়রি আকারে রচিত। এজন্য এটি ‘মুরারি গুপ্তের
কড়চা’ নামেও পরিচিত। এতে শ্রীচৈতন্যের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের নানা
গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা আছে। বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম জীবনীকাব্য চৈতন্যভাগবত (১৫৪৮) তাঁর মৃত্যুর ১৫ বছর পরে
রচিত হয়। শ্রীচৈতন্যের ঘনিষ্ঠ সহচর নিত্যানন্দের উৎসাহে বৃন্দাবন দাস প্রায় ২৫
হাজার জোড় চরণে এ বিশাল কাব্য রচনা করেন। মুরারি গুপ্ত রাধাকৃষ্ণের যুগলরূপ
হিসেবে চৈতন্যদেবের ভাবমূর্তি তুলে ধরেন, আর বৃন্দাবন দাস শ্রীকৃষ্ণের অবতাররূপে
চৈতন্যলীলা প্রচার করেন। সময়ের দিক থেকে লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল (১৫৭৬) দ্বিতীয় এবং ষোলো শতকের
শেষদিকে একই নামে জয়ানন্দ রচনা করেন তৃতীয় গ্রন্থ। তুলনামূলকভাবে লোচনদাসের
চৈতন্যমঙ্গল অধিক পরিশীলিত ও বৈদগ্ধ্যপূর্ণ। তিনি নিজ বাসস্থান শ্রীখন্ডের ভাবধারা
অনুযায়ী ‘গৌরনাগর’ রূপে শ্রীচৈতন্যের ভাবমূর্তি তুলে ধরেন। চৈতন্যদেবের চতুর্থ জীবনীকাব্য কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত 'চৈতন্যচরিতামৃত' (১৬১২)।
কৃষ্ণদাস বৃন্দাবনের অন্যতম গোস্বামী রঘুনাথ দাসের শিষ্য ছিলেন। প্রামাণিক তথ্য,
বিষয়বৈচিত্র্য, রচনার পারিপাট্য প্রভৃতি গুণে কাব্যখানি পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে।
চৈতন্যজীবন মুখ্য বিষয় হলেও এতে বৈষ্ণবধর্মের তত্ত্ব, দর্শন, বিধিবিধান, সমকালের
ইতিহাস, সমাজ এবং ঐতিহ্যের নানা তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। রাধাকৃষ্ণের যে ঐশী প্রেম ও
ভক্তিবাদের ওপর গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম প্রতিষ্ঠিত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রীচৈতন্যকে তারই
বিগ্রহরূপে চিত্রিত করেছেন। পাঠকনন্দিত এ কাব্যখানির একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত
হয়েছে। সম্প্রতি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডওয়ার্ড সি ডিমকের ইংরেজি
গদ্যানুবাদ টনি কে স্টুয়ার্টের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে।চৈতন্য চরিতামৃত
কৃষ্ণদাস কবিরাজ কর্তৃক প্রণীত। এটি কৃষ্ণ চৈতন্যের (১৪৭৮-১৫৩৩) প্রতি নিবেদিত
চরিত সাহিত্য ধারার চূড়ান্ত প্রামাণ্য রচনা হিসেবে মর্যাদাময় আসনে অধিষ্ঠিত। গ্রন্থটির
মূল পাঠ ষড় গোস্বামীদের দ্বারা বিকশিত অধিবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা ও নন্দনতত্ত্বের
মৌলিক তত্ত্বীয় অবস্থানের রূপরেখা দান করে এবং ভক্তজনোচিত ধর্মীয় কৃত্যের
সারবস্ত্ত ব্যক্ত করে। এটি যেহেতু বিশ্বকোষের মতো, সে কারণে এটি ঐতিহ্যের ধারায়
সবচেয়ে পুনর্গঠিত পাঠ এবং অন্যসব রচনার মাপকাঠিতে বলা যায় যে, এটি ধর্মতাত্ত্বিক
রচনার যথার্থ মান সৃষ্টি করেছে।
চৈতন্যদেবের অবদান আলোচনা করতে গেলে প্রথমে
তৎকালীন যুগে গঙ্গার ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর আলোকপাত করা দরকার।অধুনা কৃষ্ণনগর থেকে
প্রায় ১৬ কিমি দূরে ধুবুলিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রায় ৩ কিমি আগে বেলপুকুর বলে
একটা গ্রাম আছে। সেই গ্রামের পাস দিয়ে
একটা খাল বয়ে গেছে যেটা স্থানীয় মানুষের ভাষায় আদি গঙ্গা। প্রচলিত কথায় আঠেরোশো সালে প্রবল বন্যায় গঙ্গা
দিক পরিবর্তন করে। দিক পরিবর্তনের পর
বর্তমান গঙ্গার প্রবাহ পথে গঙ্গার একদিকে নবদ্বীপ আর ওপর দিকে কৃষ্ণনগর। বর্তমানে কৃষ্ণনগর আর শান্তিপুর গঙ্গার একই
দিকে অবস্থিত। কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য
চরিতামৃতে লেখা আছে চৈতন্যদেবের সময়
শান্তিপুর আর নবদ্বীপ গঙ্গার একই পাড়ে ছিল। বর্তমান বেলপুকুর গ্রামের খাল আদি
গঙ্গা হিসেবে ধরে নিলে এই হিসেবে মিলে যায়
যে চৈতন্যদেবের সময় শান্তিপুর আর নবদ্বীপ একই দিকে ছিল।
চৈতন্য দেবের সময় বাংলায় হুসেন শাহের আমল চলছে।উইকিপেডিয়ার
তথ্য হিসেবে মাদালা পাঞ্জির মতে হুসেন
শাহের সেনাপতি শাহ ইসমাইল গাজি ১৫০৮-০৯ সালে মান্দারান দুর্গ (বর্তমান হুগলি জেলা)
থেকে তার অভিযান শুরু করেন এবং পুরি পৌছান। পথে জজপুর ও কটক আক্রমণ করা হয়। উড়িষ্যার গজপতি শাসক প্রতাপরুদ্র দক্ষিণের
অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন। এ সংবাদ পেয়ে তিনি ফিরে আসেন। তিনি বাংলার সেনাবাহিনীকে
পরাজিত করেন ও বাংলার সীমান্ত পর্যন্ত তাদের পিছু নেন। আর. সি. মজুমদার দাবিমতে
উড়িষ্যা অভিযানের সময় তিনি কিছু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেন। (তথ্যসূত্র:
উইকিপেডিয়া) হুসেন শাহের মন্ত্রীদের মধ্যে দুজন হিন্দু উচ্চ
পদে আসীন ছিলেন -রূপ গোস্বামী আর সনাতন গোস্বামী। রূপ গোস্বামী আর সনাতন গোস্বামী চৈতন্যদেবের
অনুসারী হন|চৈতন্য চরিতামৃতে যেভাবে ঘটনার বর্ণনা আছে তার সাথে তৎকালীন ইতিহাস
মেশালে মোটামুটি যে কাহিনী দাঁড়ায় সেটা হলো - হুসেনশাহের মূল কূটনৈতিক পরামর্শদাতা
ছিলেন রূপ গোস্বামী আর সনাতন গোস্বামী। হুসেনশাহ উড়িষ্যা দখল করার জন্য এই দুজন
মন্ত্রীর থেকে পরামর্শ চান। উড়িষ্যায় তখন
হিন্দু শাসন চলছে। এই দুজন মন্ত্রী
চৈতন্যদেবকে উড়িষ্যা দখলের অভিপ্রায় জানান।
চৈতন্যদেব ওনাদের বৃন্দাবন চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। হুসেনশাহ সনাতনকে বন্দী বানিয়ে ফেলেন। পরে সনাতন ঘুষ দিয়ে জেল থেকে পালিয়ে যান। প্রথমে পালতে ব্যর্থ হলেও পরে পালতে সক্ষম
হন। চৈতন্যদেব নিজে পুরী যান। সেখানে কৃষ্ণনাম প্রচার করেন। হুসেনশাহ চৈতন্যদেবের ক্ষমতা জানতেন। তাই তিনি
পুরী আক্রমণের আর চেষ্টা করেননি। আসলে
চৈতন্যদেব পুরীকে মুসলিম আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন।
চৈতন্যদেব ছিলেন ভারতে প্রথম অহিংস আন্দোলনের জনক। যদিও এই কথার কোনো ঐতিহাসিক সমর্থন নেই। তবু বিভিন্ন ঘটনা কোলাজের মতো সাজালে এই চিত্রই
সামনে আসে।
নদীয়াতে কাজী হরিনাম সাধনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি
করলে চৈতন্যদেবের নির্দেশে শান্তিপুর নবদ্বীপ (নদীর একই পাড়ে নবদ্বীপ আর শান্তিপুর)
আর কৃষ্ণনগরের দিক থেকে দলে দলে কীর্তনিয়া কাজীর বাগানে এলে কাজী ভয় পেয়ে যান এবং
চৈতন্যদেবের সাথে সমঝোতা করেন। হুসেন শাহ
কাজীকে নির্দেশ দেন চৈতন্যদেবের সাথে কোনো সংঘাত না করতে।
চৈতন্যদেবের প্রথম স্ত্রী সাপের কামড়ে মারা গেলে চৈতন্যদেব ঝুড়ি কোদাল নিয়ে
জঙ্গল সাফাই অভিযান করেন (লোচনদাস ঠাকুরের চৈতন্যমঙ্গল)। স্বচ্ছ ভারত অভিযানের
এটাই আদি সূচনা। চৈতন্যদেব নিজে কুসংস্কার
মানতেন না। বৃন্দাবনে থাকার সময় নদীতে
জেলেদের নৌকায় প্রদীপ দেখে গ্রামবাসী ভেবেছিলো কৃষ্ণ ঠাকুর নাচ করছেন। চৈতন্যদেবের পার্ষদ ওনাকে কৃষ্ণ দর্শনের জন্য
অনুরোধ করলে উনি মূর্খের মতো কথা বলে তিরস্কার করেন আর এটাও বলেন যে কলিকালে কি
কৃষ্ণ ঠাকুর আস্তে পারে? (চৈতন্যচরিতামৃত)।চৈতন্যচরিতামৃততে যেভাবে ওনার মৃত্যুর
বার্তা আছে সেটা হলো - পায়ে আঘাত লেগে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আধুনিক বিজ্ঞানের চোখে দেখলে ওনার সেপ্টিসেমিয়া
হয়ে যায়। উনি যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে
বিকারগ্রস্থ অবস্থায় সমুদ্রে ঝাপ দেন।
পরের দিন কোনার্কের কাছে এক জেলের মাছের জালে ওনার দেহ পাওয়া যায়। সমুদ্রের লবন জলে ওনার শরীরের রং পরিবর্তিত হয়ে
যায়। কোনার্কের কাছে ওনার দেহ দাহ করা হয়।
তবে ওনার মৃত্যুর খবর প্রচার হতে দেয়া হয়নি। চৈতন্যচরিতামৃতে আছে - না হয়
"চাউল"। এখানে পাণিনির র আর ল অভেদ সূত্র প্রয়োগ করলে চাউল কথাটা হয়ে
যায় চাউর। চাউল কথাটা বাউল শব্দের সাথে
ছন্দ মিল করতে বলা হয়েছে। কিছুটা হেঁয়ালিও
বটে। এটা লেখকের (আমার) অনুমান যে
মুসলিম শাসকের কাছ থেকে ওনার মৃত্যু সংবাদ গোপন করা হয়েছিল বৃহত্তর
স্বার্থে।
No comments:
Post a Comment