Thursday, 18 May 2017

আমার শ্রদ্ধা -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আধুনিক বাঙালী মনের দিশারী



আমার শ্রদ্ধা -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আধুনিক বাঙালী মনের দিশারী

নারী, পোশাক আর শরীর -এই তিনটি শব্দ সাহিত্যের ঊষালগ্ন থেকে লেখক আর পাঠক সবাইকেই একসূত্রে বেঁধে রেখেছে।  ব্রহ্মা যেদিন প্রথম অহল্যাকে সৃষ্টি করলেন সেটাই বোধহয় সাহিত্যের যৌবনকালের সূচনা।  অহল্যার সৃষ্টি পুরাণের গল্প।  সত্য মিথ্যা বিচার না করলেও চলবে।  তবে অহল্যার যৌবন সাহিত্যিকের কলমে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে।  কি পুরুষ কি মহিলা সকলেরই মনের মাঝে প্রথম ভাব রতি, প্রথম রিপু কাম, প্রথম রস শৃঙ্গার। অহল্যার সৃষ্টি আমার মনেহয় এক প্রতীক - সাহিত্যে নারীর স্থান। ২০১৬ সালের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত  বব ডিলানের কথায়: 
“I think women rule the world and that no man has ever done anything that a woman either hasn't allowed him to do or encouraged him to do.”
আর এখানেই মনেহয় অহল্যার জয়যাত্রা। ভাষা বাহন শিল্পে নারীর দুটো সৌন্দর্য। এক মানসিক আর দুই শারীরিক। নারীর শারীরিক সৌন্দর্য শিল্পের চোখে মনেহয় সবথেকে রহস্যে মোড়া এক অধ্যায় যা পুরুষ আর নারী দুজনকেই কোনো এক অদৃশ্য আকর্ষণে টেনে রেখেছে।নারীর দেহ বা শরীর যখন শিল্পের ভাষা পায়, তখন চারুশিল্প আর কারুশিল্পের সংমিশ্ৰনে সৃষ্টি হয় অজন্তা ইলোরার গুহাচিত্র, খাজুরাহের মন্দির। নারী পুরুষের মিলন সেখানে শিল্প। যৌনতা নয়। ভাষার লাবণ্যে কালিদাসের শকুন্তলা প্রাণ পায়। পার্বতী মহাদেবের সাথে শৃঙ্গার করে। অথচ কিছু শব্দের  (যেমন স্তন নিতম্ব, কাঁচুলি) অশুভ প্রয়োগে, বর্ণনার বৈগুণ্যে হয়েযায় নন্দিত থেকে নিন্দিত।
নারীর মানসিক সৌন্দর্যের আবেদন সাহিত্যে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার সাথে সমাজে অধিকমাত্রায় কার্যকর। আইনের ভাষায় ১৪ সেকেন্ডের বেশি কোনও মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে নাকি সেটা সেক্সচুয়াল হ্যারাসমেন্ট বলে গণ্য হয়। অথচ নির্ভয়ার ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড দিতে আইনের লেগেযায় চার বছর।  চোখের ভাষায় যখন প্রেম থাকে তখন সময়কে বেঁধে রাখা যায় না। আবার পুরুষের চোখের ভাষায় যখন থাকে লালসা, তখন হয় নৈতিকতার স্খলন। আর এই লালসা যখন শারীরিক হয় তখন হয় মানবতার পতন।  সেক্ষেত্রে মানসিক সৌন্দর্যের  আবেদন সাহিত্যের থেকেও সমাজে অনেক বেশী জরুরি।
পোশাকের সাথে মেয়েদের একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। স্বামী বিবেকানন্দের কথায় (প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শীর্ষক প্রবন্ধে পোশাক অধ্যায়ে) পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে মেয়েরা বুক খোলা  সান্ধ্য পোশাক পরে অতিথিদের আপ্যায়ন করে।  ভারতে আবার অতিথি এলে মহিলারা ঘোমটা টেনে নেয়।  ঘোমটা টানতে গিয়ে মেয়েদের আবার কোমর থেকে কাপড় উঠে গেলেও খেয়াল থাকে না।  রাজদরবারে  নর্তকীরা তো দিব্বি উলঙ্গ।   কোমর থেকে কয়েক ফালি কাপড় ঝুলছে তাতেই তারা স্বচ্ছন্দ।  বাস্তবিক পক্ষে পোশাক একজন মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা।  পোশাকের সাথে শারীরিক সৌন্দর্য্যের প্রত্যক্ষ সংযোগ থাকলেও মানসিক সৌন্দর্যের কোনো সম্পর্ক নেই।  আর এই ভুলটাই বার বার করে আমরা মানসিক সংকীর্ণতার পরিচয় দিতে থাকি।    
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পের চরিত্রগুলোকে বুঝতে গেলে আজকের সামাজিক সমীকরণের দিতে একটু দৃষ্টিপাত করা দরকার।  প্রচলিত কনভেনশন হলো সম্পর্কের ছেলের বয়স বেশি মেয়ের কম -এটাই কাম্য।  কোনো কোনো মেয়ে আবার দশ বছরের বেশি পার্থক্যকে সঠিক বলে মনে করেন।  বিষয়টা মূলত নির্ভর করে মেয়েদের বায়োলজিক্যাল সার্কলের ওপর।  মেয়েদের মানসিক ম্যাচুরিটি ছেলেদের থেকে আগে আসে আবার মেনোপজ মেয়েদের অনেক আগে আসে।  ছেলেদের সেই অর্থে অনেক পরে। শারীরিক প্রয়োজনের সাথে অর্থনৈতিক স্টেবিলিটিটাও জরুরি। অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর হতে গেলে ছেলেদের অনেকটা সময় লেগে যায়।  মেয়েদের সন্তান ধরণের সাথে বয়সের একটা যোগসূত্র থাকায় স্বাভাবিক নিয়মেই মেয়েদের একটি নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে অধিক বয়সের অর্থনৈতিক স্বনির্ভর ছেলের সাথে বিয়ে দেয়া হয়। এটাই রীতি।   আজকের দিনে দাঁড়িয়ে  সমাজে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ছেলে মেয়ে দুজনকেই আজকের দিনে স্বনির্ভর হওয়া জরুরি। তাই ছেলে বা মেয়ে দুজনকেই ক্যারিয়ার গড়তে বেশ কিছুটা সময় দিতেই হয়।  আধুনিক কসমেটিক সায়েন্স মেয়েদের যৌবনকে অনেক বেশি পরিণতি দিয়েছে। এখন পঞ্চাশ বছরেও মেয়েরা পূর্ণ যৌবনা।  মেডিকেল সায়েন্সের কল্যানে মেনোপজের পর যৌন ইচ্ছা পূর্ণ মাত্রায় বর্তমান থাকে।  এক প্রখ্যাত সাহিত্যিকের একটা লেখায় দেখলুম -থোড়াই কেয়ার, লুব্রিক্যান্ট আছে তো। বিভিন্ন সাহিত্যিকের লেখা থেকে দেখেছি পরিণত বয়স্ক মেয়েদের, অপেক্ষাকৃত কম বয়সের ছেলেদের প্রতি একটা মনের টান তৈরী হয়।  আজকের সমাজে মানুষের জীবনদর্শন অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছে। ছেলে বা মেয়ে সবাই ক্যারিয়ার কে সবথেকে প্রায়োরিটি তে রাখে।  তারপর লাইফপার্টনার।  ছেলের চাকরি মেয়ের বিয়ে -এই ট্রাডিশনাল ধারণা আর নেই।  এখন সবার শিক্ষা, সবার অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, দুজনের সংসার।  প্রসঙ্গত পোস্ট ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার নিয়ে আজকাল অনেক কথা হচ্ছে।  এই প্রসঙ্গে কিছু কথা এখানে বলার অবকাশ রাখে।  সমস্ত প্রাণিজগতে পলিগ্যামী (একাধিক সঙ্গী বা সঙ্গিনী)একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য।  মানুষের সমাজে মোনোগ্যামি (এক সঙ্গী বা সঙ্গিনী)  একটা আরোপিত বৈশিষ্ট্য।  অর্জিত নয় (জেনেটিক ক্যারেক্টার নয়) । ফলে সমাজে মানুষ যত ব্যক্তি স্বাধীনতা খুঁজবে, ততই ওই ডরম্যান্ট পলিগ্যামি জীন প্রকট হতে  থাকবে।  যদিও এটা ব্যক্তিগত মতামত তবু অনেকটাই বায়োলজি  সমর্থিত। মিউটেশন আর লামার্ক মতবাদ নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করে আমার মনেহয়েছে  কথাটা বিতর্কিত হলেও খুব একটা ভুল নয়। যেমন কুড়ি প্রজন্ম ধরে ইঁদুরের লেজ কেটে দিলেও লেজকাটা ইঁদুর জন্মায়না।  কারণ আরোপিত বৈশিষ্ট্য বংশানুসরণ করেনা। কোনো ক্যারেক্টার যখন জেনেটিক্যালি অর্জিত হয় তখনি সেই বৈশিষ্ট্য বংশানুসরণ করবে।   তাই মানুষ হিসেবে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে আত্মসম্মান আর সামাজিক স্বীকৃতি - এই দুটি বিষয় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ।  বয়স বা বহুগামিতা এগুলো গৌণ। 
  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখতে গিয়ে নারীর পোশাক আর শরীর এই নিয়ে এতো বিস্তারিত ভূমিকা করা বিশেষ প্রয়োজন ছিল। রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী আধুনিক সাহিত্যের কোনো নির্দিষ্ট সূচনাকাল না থাকলেও মোটামুটি ভাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কীর্ত্তিবাস পত্রিকাকে একটা মাইলস্টোন ধরা যেতে পারে।  আধুনিক বাঙালীকে যে মানুষটা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন তিনি সুনীলবাবু। এই স্বাধীনতার মূল বিষয় অবশ্যই  নারী স্বাধীনতা।  নারীর পোশাকের স্বাধীনতা।  নারীর আবেদনের স্বাধীনতা।  পোশাকের সাথে মনের বা চরিত্রের যে কোনো সম্পর্ক নেই, সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে সেটাই সুনীলবাবু শিখিয়েছেন।  সাহিত্যের ভাষায় উনি বাঙালিকে পরিণত করেছেন।  স্বাধীন করেছেন।  নারীর আবেদনকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। কোনো মেয়ের শরীরের আবেদন আস্বাদনে  কোনো অপরাধ নেই, যদি সেই আস্বাদন বা স্বাদ সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে, সম্মানে মধ্যে দিয়ে, সৌজন্যের মধ্যে দিয়ে হয় ।  সুনীলবাবু মেয়েদেও স্বাধীন করেছেন।  ভালোবাসলে চুমু খাওয়া অপরাধ নয়।  শরীরের টান পুরুষ মহিলা দুজনেরই আছে। সুনীলবাবু বাঙালী পুরুষ বা নারী দুজনের হাতেই হুইস্কির গ্লাস স্বচ্ছন্দে তুলে দিয়েছেন।  কোনো যুবতী মেয়ের চলার ছন্দে কোমর আর বুকের আন্দোলন উপভোগ করতে শিখিয়েছেন।  সুন্দরী যুবতীকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়া যুবককে দেখে মনে ঈর্ষা জাগাকে উনি সম্মান করেছেন।  স্বামীর অবর্তমানে স্বামীর বন্ধুর সাথে বৌয়ের ফ্লার্টিং উনি স্বচ্ছন্দে স্বীকৃতি দিয়েছেন। স্বামীকে লুকিয়ে পুরোনো প্রেমিকের সাথে শারীরিক মিলনকে ওই স্বাগত করেছেন।  দুজন মহিলার কোমরের সৌন্দর্য কে উনি তারিফ করেছেন।  কিছু কিছু পুরুষের তীব্র আকর্ষণ শক্তির কাছে মেয়েদের অসহায় সমর্পনকে উনি গ্রহণ করেছেন।  পরকীয়া, পোস্ট ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার, একাধিক সম্পর্ক, কিশোর কিশোরীর চুম্বন, হুইস্কির গ্লাস সবকিছুই সুনীলবাবুর ভাষায় সাবলীল। 

তবু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।  কোনো পুরুষ কোনো মেয়ের চুলের ঘ্রান নিয়ে তারিফ করতে পারে, বলপূর্বক বুকে হাত দিতে পারেনা। মেয়েদের সম্মান করলে গুন্ডাও ভয় পায় একজন নিরস্ত্র মানুষের গায়ে হাত দিতে। সুনীলবাবুর স্বাধীনতায় সম্মান আর সৌজন্যবোধ সবসময় অগ্রাধিকার পেয়েছে। সম্মতি ছাড়া কোনো মহিলাকে স্পর্শ করাকে উনি কখনোই সমর্থন করেননি।   আজকের সমাজে তাই সুনীলবাবুর সমস্ত লেখাকে ভীষণ প্রাসঙ্গিক মনে হয়।  উনি ওনার সময় থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আধুনিক ছিলেন।  ওনার সময় মোবাইল ফোন ছিলোনা।  তবু উনি সেই সময় যে আধুনিক মুক্ত মনের সমাজের কথা বলে গেছেন, সেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা আর আত্মসম্মান সর্বাধিকার পেয়েছে।  একজন ধর্ষিতা মেয়ের চোখের জলের সম্মান দিয়ে একজন বাবার যন্ত্রনা উনি বৃক্ষরোপনের মধ্যে দিয়ে মুক্ত করেছেন। অনেক দাম্পত্য প্রেমের শিকড় পুরুষ বা নারীর শারীরিক আবেদনের ওপর নির্ভর করেনা, নির্ভর করে মানসিক টানের ওপর।  আজকের সমাজে যখন সাধারণ সম্পর্কগুলো দিক খুঁজে পায়না, ভালো মন্দের দ্বন্দ্বে সমাসবদ্ধ হয়না, তখন সুনীলবাবুর প্রতিটি লেখাকে মনেহয় সবথেকে প্রাসঙ্গিক। সুনীল বাবুর লেখা থেকে লাইন তুলে প্রতিটা কথার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।  সেক্ষেত্রে এটা থিসিস পেপার হয়ে যাবে। আজকের সমাজে সুনীল বাবুর প্রাসঙ্গিকতাকে বোঝার জন্য, ওনার উপন্যাস, গল্প বার বার পড়া দরকার। আমার প্রিয় সাহিত্যিক কে এটাই আমার শ্রদ্ধার্ঘ।     

No comments:

Post a Comment