Thursday, 18 May 2017

প্রসঙ্গ ডাকঘর -নবজাগরণের দিশারী



ডাকঘর নাটকের শেষ অঙ্ক:-
সুধার প্রবেশ
সুধা। অমল।
রাজকবিরাজ। ও ঘুমিয়ে পড়েছে।
সুধা। আমি যে ওর জন্যে ফুল এনেছি —ওর হাতে কি দিতে পারব না?
রাজকবিরাজ। আচ্ছা, দাও তোমার ফুল।
সুধা। ও কখন জাগবে?
রাজকবিরাজ। এখনই, যখন রাজা এসে ওকে ডাকবেন।
সুধা। তখন তোমরা ওকে একটি কথা কানে কানে বলে দেবে?
রাজকবিরাজ। কী বলব?
সুধা। বোলো যে, ‘সুধা তোমাকে ভোলে নি’।
এখানে অধিকাংশ সমালোচক রাজা বলতে মৃত্যুকে ভেবেছেন আর অমলকে মৃত বলে ভেবেছেন।  নাটকে ট্রাজেডি আনতে বিশিষ্ট নাট্যকারগণ অমলের মৃত্যু মঞ্চস্থ কোরেছেন। একটু গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে রবীন্দ্রনাথ ইচ্ছে করেই অমলকে সরাসরি জীবিত বা মৃত প্রকাশ করেননি।  এটাই ব্যঞ্জনা।  সুধা একটা মেয়ের নাম।  সুধা মানে অমৃত।   অমৃত পান করলে মানুষ  অমর হয়। নাটকে সুধা ফুল নিয়ে এসেছিলো। এটা জীবনের অর্থবহ।  অমলের ঘুম ভেঙেছিল না ভাঙেনি সেটা বিচার করা অনর্থক।  কারণ লেখক সেটা পরিষ্কার করে বলেননি।  তবে, নাটকে রাজা কে, সেটা রবীন্দ্রনাথ পরিষ্কার বলেছেন।  তবে সেটা প্রবল ব্যঞ্জনার মোড়কে।  আর সেখানেই রয়েছে পুরো ডাকঘর নাটকের সার্থকতা।  নামকরণের সার্থকতা সেইখানে।  ডাকঘর নাটকে রাজা কে, সেটা বুঝতে গেলে একটা বিশেষ সংলাপ বিশ্লেষণ করতে হবে।
“ঠাকুরদা। হাঁ, আমি খেপেছি। তাই আজ এই সাদা কাগজে অক্ষর দেখতে পাচ্ছি। রাজা লিখছেন তিনি স্বয়ং অমলকে দেখতে আসছেন, তিনি তাঁর রাজকবিরাজকেও সঙ্গে করে আনছেন”
সাদা কাগজ' এটাই পুরো ডাকঘর নাটকের তুরুপের তাস। সমস্ত হেঁয়ালি, সমস্ত কাব্য, সমস্ত ব্যঞ্জনা এখানে। আর তার জন্যই রবীন্দ্রনাথ। সাদা কাগজ ইংলিশ করলে দাঁড়ায় হোয়াইট পেপার। হোয়াইট পেপার একটা লিগাল শব্দ। যার অর্থ সরকারি পরোয়ানা।
White papers are a way the government can present policy preferences before it introduces legislation. Publishing a white paper tests public opinion on controversial policy issues and helps the government gauge its probable impact. (Wikepedia)
অর্থাৎ রাজা সরকারি পরোয়ানা পাঠিয়েছেন, রাজবৈদ্য আসছেন। রাজবৈদ্য হলো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এলোপ্যাথি ডাক্তার। এলোপ্যাথি ডাক্তার এসে প্রাচীন অর্ধ শিক্ষিত (হাতুড়ে) বৈদ্যকে অপসারণ করেন। ভারতীয় সমাজে এটা নবজাগরণের বার্তা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ পর্যায় 1945, 2 মে। হিটলার আত্মহত্যা করার প্রাক মুহূর্ত । সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সাথে জার্মান সেনার রাস্তায় মুখোমুখি যুদ্ধ হচ্ছে। সেই সময় শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের "ডাকঘর' পথনাটক করা হয়েছিল জার্মানের রাস্তায়। WIkipedia জানাচ্ছে "It had a successful run in Germany with 105 performances and its themes of liberation from captivity and zest for life resonated in its performances in concentration camps where it was staged during World War II." from "Tagore for today". The Hindu. August 30, 2012 | এর থেকে একটা সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর অনেক বিদগ্ধ মনীষীর মনেই দাগ কেটেছিল।
নাটকের আরো কিছু সংলাপ বিশ্লেষণ করা যাক।
'অমল। আমি জানি নে। আমি তো কিচ্ছু পড়ি নি,
 তাই আমি জানি নে আমার কী হয়েছে। দইওআলা,' 
 অমল জানেই না যে তার কি হয়েছে। সে শুধু জানে যে বৈদ্য তাকে ঘরের বাইরে যেতে মানা করেছে। কারণ তার অসুখ করেছে।
মাধব দত্ত কবিরাজ যে বলেছে বাইরে গেলে তোমার অসুখ করবে
অমলের পিসেমশাইয়ের সংলাপ। মাধব দত্ত, অমল কে দত্তক নিয়েছিল (adopted uncle)। করবে- এটা ভবিষ্যত কাল। বর্তমান কালে অমলের কি অসুখ সেটা তো অমল জানেই না। বৈদ্য ডায়াগনসিস করেছে যে 'বাত পিত্ত শ্লেষ্মা' . বৈদ্য যে ঠিক নির্ণয় করেছে সেটা বলা কঠিন। কারণ বৈদ্যের ডাক্তারি বিদ্যার যে নাটকীয় ব্যাঙ্গ রবীন্দ্রনাথ লেখনীতে মিশিয়েছেন, তাতে বৈদ্যের পুথিগত জ্ঞান কতটা সঠিক সেটা বিচার্য। যে দুর্বোধ সংস্কৃত লেখা রয়েছে, আর তার যা অর্থ বৈদ্য করেছে, সেটা দুর্বোধ শব্দটারি মত। ব্যুত্পত্তি বা শব্দের জন্ম পদ্ধতি বিচারে দুর্বোধ সঠিক শব্দ। যদিও দুর্বোধ্য কথাটা বাংলায় বহুল প্রচলিত। তবে ওই য ফলা ব্যাকরণ বিচারে শুদ্ধ বলা যায় না। সেরকমই লেখকের হাস্যরস বৈদ্যের বিদ্যা নিয়ে সংশয় রেখেই দেয়। সেই সাথে অমলের রোগ যতটা না কঠিন ছিল, তার থেকেও ছিল কঠিন স্নেহ। যেটা বাংলা প্রবচন কে মনে করিয়ে দেয় - স্নেহ অতি বিষম বস্তু। 
ছেলেরা খেলতে যাচ্ছে মাঠে -
ছেলেরা। আমরা চাষ-খেলা খেলব।
অমল। সমস্ত দিন খেলবে?
ছেলেরা। হাঁ, সমস্ত দি —ন।
অমল। কবিরাজ আমাকে বেরিয়ে যেতে মানা করেছে।
ছেলেরা। কবিরাজ! কবিরাজের মানা তুমি শোন বুঝি! চল্ভাই চল্‌, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এখানে ব্যঞ্জনার দুটি দিক দেখা যাচ্ছে। একটা দিক হলো অনেক কিশোর ছেলেই কবিরাজের কথা শোনেনা। নবীন কিশোর ছেলেরা চাষ-খেলা খেলবে। এটা ভবিষ্যতের শিল্প তান্ত্রিক সমাজের ইঙ্গিত। 
বৈদ্যের চিকিৎসা যে ভুল ছিল তার প্রমান রাজবৈদ্যের প্রবেশ। বৈদ্য ছিল কবিরাজ। ডাকঘরের রচনাকাল 1912। সেই সময় ভারতীয় চিকিৎসাতে অ্যালোপ্যাথি প্রবেশ করেছে। প্রাচীন কবিরাজি চিকিৎসাতে সঠিক বিদ্যার অভাবে নিয়ম ছিল রোগীকে ঘরে বন্ধ করে রাখা। কিন্তু অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা শিখিয়েছে, উন্মুক্ত বাতাস, খোলা আকাশ, সূর্যের আলো আরোগ্য লাভের প্রাথমিক প্রয়োজন। রাজবৈদ্য সেই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে পারদর্শী। সহজ কথায় অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার।
ডাকঘরে , রবীন্দ্রনাথ অমলকে প্রকৃত মারতে চেয়েছিলেন কিনা সেটা বলা শক্ত। নাটক মঞ্চস্থ করতে গেলে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ইফেক্ট (effect) হলো ট্রাজেডি। ট্রাজেডি বেশী করে মন কে নাড়া দেয়। সেই কারণে নাটকের সার্থে কবিগুরু অমলের মৃত্যু বার্তা টা রহস্য জালে মুড়ে রেখেছেন।  তবে "ডাকঘর' সমাজের কাছে এক নতুন বার্তা নিয়ে এসেছে। সেটা মৃত্যু নয়। জীবনের বার্তা। পরিবর্তনের বার্তা। আধুনিক শিক্ষার বার্তা। কু - সংস্কার মুক্ত মনের বার্তা। যাকে পরিভাষায় বলাযায় কান্তা সম্মিত বাণী যা আত্মিক লোকে সর্ব মানব চিত্তের মহাদেশে বিরাজ করে। 1917 সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম যখন ডাকঘর নাটক মঞ্চস্থ করেন, তখন তিনি কিছু গান নাটকে প্রয়োগ করেন। যদিও মুল নাটকে কোনো গান নেই। তার মধ্যে একটা গান হলো - ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে। এই গান জীবনের গান। মৃত্যুর গান নয়। অমল যখন ঘুমিয়ে পরে তখন তার জন্য ফুল এনেছিল সুধা। সুধা নামের ভাব লক্ষনা গত অর্থে জীবনের জয়গান গায়। বিদেশী লেখকের চোখে ডাকঘর নবজাগরণের বার্তা আনে। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান কে নতুন আলোতে জাগাতে 105 বার ডাকঘর নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। যেখানে বন্দী জীবন থেকে মুক্তির আনন্দ ফোটানো হয়েছে। 

     উপসংহারে শেষ প্রশ্ন টা থেকে গেল। অমলকে দেখতে যে রাজা আসার কথা ছিল তিনি কোন রাজা? সেই উত্তর খোঁজার জন্য মন সন্ধান করলো শব্দের চতুর্বিধা শক্তিকে । সেটা হলো তাৎপর্য। মম্মটভট্টের টীকা তে, তাৎপর্যকে চতুর্বিধা শক্তি বলা হয়েছে। এখানে রাজার আগমনের তাৎপর্য হলো রেনেসাঁ বা নবজাগরণের বার্তা। পরিবর্তনের বার্তা। ডাকঘর নাটকে রাজা হলো রেনেসাঁ বা নবজাগরণ।

1 comment:

  1. A complete list of games that I am currently playing in my casino
    I am also 천안 출장샵 a big fan of slot 삼척 출장안마 machines 진주 출장마사지 and 광양 출장안마 I would say that my favorite is Starburst, and I have already 목포 출장마사지 tried many different casino games.

    ReplyDelete