1
বনলতা সেন
কবি জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম
শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে বিবেচ্য। বনলতা সেন প্রধানত রোমান্টিক গীতি কবিতা হিসেবে
সমাদৃত। কবিতাটি যথেষ্ট বিতর্কিত। কিছু তথ্যসূত্রতে দেখাযায় বনলতা সেন বলে একজন
স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। সেই বনলতা সেন আর কবিতার বনলতা সেনের কোনো সম্পর্ক আছে
কিনা বলা মুশকিল।
উইকিপেডিয়াতে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যেবনলতা সেন" কবিতাটি
প্রথম প্রকাশ করেছিলেন কবি বুদ্ধদেব
বসু তাঁর কবিতা পত্রিকায়। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের
ডিসেম্বরে প্রকাশিত কবিতার পৌষ, ১৩৪২ সংখ্যার মাধ্যমে বনলতা সেন সর্বপ্রথম পাঠকের
হাতে এসে পৌঁছায়। জীবনানন্দ দাশ বাংলা ১৩৪৯, ইংরেজি ডিসেম্বর ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে
প্রকাশিত তাঁর বনলতা সেন নামক তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি
অন্তর্ভুক্ত করেন। কবিতা-ভবন কর্তৃক প্রকাশিত "এক পয়সায় একটি"
গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত হিসেবে। প্রকাশক ছিলেন জীবনানন্দ দাশ নিজেই। ১৬ পৃষ্ঠার
প্রথম সংস্করণে কবিতা ছিল মোট ১২টি। প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছিলেন শম্ভু সাহা।[১] পরবর্তীকালে জীবনানন্দ দাশ ১৯৪৪ এ প্রকাশিত তাঁর চতুর্থ কাব্য মহাপৃথিবীতে উক্ত বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের সকল
কবিতাই অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। অর্থাৎ ‘‘মহাপৃথিবী’’ কাব্যগ্রন্থেরও প্রথম কবিতা
ছিল ’বনলতা সেন’। কবির জীবদ্দশায় বাংলা শ্রাবণ, ১৩৫৯, ইংরেজি ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে
কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে বনলতা
সেন কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয়
সংস্করণটি প্রকাশিত হয়। ৪৯ পৃষ্ঠার বর্ধিত কলেবরে প্রকাশিত সংস্করণে আগের ১২টি
কবিতার সাথে আরও ১৮টি কবিতা যোগ করে মোট ৩০টি কবিতা প্রকাশিত হয়। এই সংস্করণের
প্রচ্ছদ করেছিলেন সত্যজিৎ রায় ও মূল্য ছিল ২ টাকা।
কবিতাটি
সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিচার করলে, কবিতাটি প্রেমের কবিতা কিনা সেই বিষয়ে অনেক প্রশ্ন
জাগে।
প্রথমতঃ
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতোদিন কোথায় ছিলেন?'
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
এখানে ‘ছিলেন’
সম্বোধনটা বিতর্কিত। প্রেমাস্পদকে কেউ ছিলেন সম্বোধন করবে না।
দ্বিতীয়তঃ
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
দুদন্ডের শান্তি কথাটা সাধারণ
মানের বিচার বিশ্লেষণে প্রেমের সাথে অনেকেই সম্পর্কিত করতে পারেন। তবে জীবনানন্দ
দাশের মতো বিশ্বমানের কবিদের কবিতা বিচার করতে গেলে একটু শাস্ত্রীয় মতের দ্বারস্থ
হতে হয়। উজ্জ্বলনীলমনি গ্রন্থের বিচারে প্রেমের সংজ্ঞা হলো - ধ্বংসের কারণ হওয়া
সত্ত্বেও যা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়না। সেই বিচারে দুদন্ডের শান্তি শাস্ত্র মতে কামের
নির্দেশ করে। প্রেম নয়।
তৃতীয়তঃ
হাজার বছর
ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল
সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
প্রেমের কবিতার কাব্যিক যে
রসতত্ত্ব আছে সেখানে পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, সঙ্গম এরকম বিভিন্ন পর্যায় আছে।
হাজার বছরের পথ আসলে কোন পথ? এই পথ প্রেমের পথ কিনা সেটা বিচার করা শক্ত। কবিতার
বিন্যাস থেকে রতি, জুগুপ্সা, ঈর্ষা কোনো ভাবই প্রকট হয় না। প্রশ্ন থেকে গেলো
-হাজার বছরের পথ তাহলে কোন পথ।
কবিতার
অর্থ বিশ্লেষণ করতে গেলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের পর্যালোচনা করতে হবে। বাংলা
ভাষা বৈদিক সাহিত্য থেকে শুরু হয়ে পালি, প্রাকৃতের মধ্যে দিয়ে পরিবর্তিত হয়ে আজকের
বাংলা ভাষায় এসেছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস শুরু হয় হাজার বছর আগের চর্যাপদের
মধ্যে দিয়ে। বাংলা ভাষায় বৌদ্ধিক দর্শন বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। পাল ও সেন যুগে বাংলা
ভাষায় বিবর্তন এসেছে। রানী ভবানীর কর্মস্থল নাটোর বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক গুরুত্ব
বহন করে। বনলতা কথার অর্থ বনজ লতা। বনলতা শব্দটা বাংলার সাথে সমুচ্চারিত বলা চলে।
কবিতার
কিছু লাইন আর তার সারমর্ম নিচে দেয়া হলো:
1
|
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
|
চর্যাপদের সময় থেকে হাজার বছরের পথ
|
2
|
বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; |
বৌদ্ধিক সাহিত্যের প্রভাব
|
3
|
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন
|
নাটোর বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। নাটোর হলো রানী ভবানীর
কর্মস্থান। বাংলা ভাষায় নাটোরের একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। নাটোরে নীল
বিদ্রোহ ১৮৫৯-১৮৬০ তে সংঘটিত হয়। ১৮৯৭ সালের জুনে নাটোরে বঙ্গীয়
প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সভাপতি, মহারাজা
জগদিন্দ্রনাথ অভ্যর্থনা নমিতির সভাপতি ও প্রধান উদ্যোক্তা
ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহারাজা জগদিন্দ্রনাথের চেষ্টায় সেবারই
প্রথম রাজনৈতিক সভায় বাংলা ভাষার প্রচলন করা হয়। (সূত্র উইকিপেডিয়া)| এই কথার সাথে
সমার্থক -বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি
|
4
|
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের 'পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর |
পালি ভাষা, প্রাকৃত ভাষা আর
ক্রম বিবর্তনে বাংলা ভাষার সৃষ্টি
|
5
|
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন
|
পাখির নীড়ের মত – উপমান
|
6.
|
ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন |
কবির মৃত্যু হয় - কবির সৃষ্টি কাব্য
জীবিত থাকে
|
বনলতা সেন কবিতায় কবি বাংলা ভাষা
আর বাংলা মায়ের প্রতি তাঁর প্রেম, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা সমর্পন জানিয়ে গেছেন।
No comments:
Post a Comment