Thursday, 18 May 2017

সাহিত্যের সেকাল ও একাল


সাহিত্যের সেকাল ও একাল 
মোবাইল টেকনোলজি সমাজে রেভোল্যুশন এনেছে দুহাজার সালের পর থেকে। দুহাজার সালের পর, বিশেষ করে যেদিন থেকে ফেইসবুক এসেছে, সেদিন থেকে - মানুষের কাছে পৌঁছনোটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। অনেকেই কবিতা লেখে, অনেকেই গল্প লেখে আবার আমার মতো কেউ কেউ হিজিবিজি লেখে। আগে অনেকেই এই লেখাগুলো বইয়ের পাতায় বন্দী করে রাখতো। আজ ফেসবুকে ভাষা উম্মুক্ত। নানান রং আর ছবির কোলাজের মাঝে লেখার প্রেসেন্টেশন। অনেকেই লেখে। সবার লেখা মনে দাগ না কাটলেও কেউ কেউ বেশ ভালোই লেখে। অনেকেই পড়ে। লাইক, রিমার্ক কতকিছু। অনেকে আবার প্রোফাইল ছবি দেখেও হয়তো লাইক করে দেয়। ঝা চকচকে প্রেসেন্টেশন। শুধু একটাই প্রশ্ন থাকে লেখাগুলো মনে কতক্ষন স্থায়ী হয় ? আবার একটা নতুন পোস্ট, নতুন মুড্। 
     যদি সময়টা একটু পিছিয়ে যাই, মানে দুহাজার সালের আগে, তখন কেমন ছিল সাহিত্য! কিছু সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকা। অথবা বই লেখা। প্রেসেন্টেশন মানে বইমেলা। এরই মধ্যে লেখককে পৌঁছতে হবে পাঠকের মনে। আর সেটা না হতে পারলে সব চেষ্টাই মাটি। লেখকের দায়িত্ব পাঠক কে দিয়ে পড়িয়ে নেয়া। মানে বই কিনতে বাধ্য করা। সেটা ভালোলাগার টানে, ভালোবাসার টানে। সেদিন সমাজ আমাদের দিয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টপাধ্যায় এনাদের মতো সাহিত্যিক। যাদের লেখা বার বার পড়েছি। বই কিনে পড়েছি। পূজাবার্ষিকী খুলেই আগে এনাদের লেখা পড়েছি। এমনকি পান্ডব গোয়েন্দা বা কিকিরা এইসব চরিত্র মনে দাগ কেটে গেছে। কবিতার কথা বললে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এনারা আজকের দিনেও প্রাণবন্ত। কি ছিল তাদের লেখাতে ? খুব সহজ কোথায় বললে ওনাদের লেখা মনে দাগ কেটে যেত। একবার পড়তে শুরু করলে আর থামা যেত না। খাবার টেবিলে, রাতের বেলা শুয়ে শুয়ে, বা টেক্সট বই এর মধ্যে লুকিয়ে। বাবা মার বকুনি, স্যারের মার সব কিছু উপেক্ষা করে পড়েছি। ভুল বললুম। লেখাগুলো পড়িয়ে নিয়েছে। আমরা পড়িনি। আমাদের পড়িয়ে নিয়েছে। বয়সের সাথে সাথে সমাজের পরিবর্তন যেন মনের কোনে উঠে এসেছে, আর মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছে গুলো ডানা মেলে উড়ে গেছে। রস নিস্পত্তি। ভাব আর বাইরের জগৎ বিক্রিয়া করে যে রস উৎপন্ন করেছে সেটা মনের সাথে মিশে গেছে। বিজ্ঞানের ভাষায় দ্রবীভুত হয়। 
 আর একটু পিছিয়ে যাই রবীন্দ্রনাথের যুগে। ছোটগল্প নিরুপমা। বিষয় পণপ্রথা। এবার বিশ হাজার পন আর হাতে হাতে আদায়। সামান্য একটা লাইন। একশো বছর পরও যার তাৎপর্য প্রাসঙ্গিক। মনের কোনায় যে রস ছড়িয়ে দেয়', সেটা জানায় - বেদনার কি ভাষা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মহেশ। আজকেও পড়লে চোখে জল আসে। দেবদাস। একটাই প্রশ্ন জাগায় - ভালোবাসা করে কয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর পদ্মানদীর মাঝি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এনারা কালজয়ী। কারণ একটাই। এনাদের লেখা সমাজের বাস্তবের সাথে মনের যন্ত্রণার সংযোগ ঘঠায়। কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন। লেখা পড়তে হয় না। লেখক পড়িয়ে নেন। একবার নয় বার বার। আর বারবার আসে নব অনুভূতির সজীবত্ব। 
 আজকে ছোট বড়ো সবারই মন অস্থায়ী। টি ভি তে সিরিয়েল দেখলে দেখা যাবে একজন মহিলা আদা জল খেয়ে পেছনে পড়ে আছে আর এক মহিলার ক্ষতি করতে, আর অন্যদিকে ছেলে মানেই নারী বিদ্বেষী নাহলে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির । আমরাও গোগ্রাসে গিলছি সেই সিরিয়াল। মেয়ের নাতনি হয়ে গেলো তারপরের আবার নতুন করে বিয়ে করতে মন চাইলো। আমাদের মনের আবেগ গুলো আজ ভীষণ জটিল সমীকরণের মাঝে সমাধান খুঁজে পায়না। আর তাই ঘুরতে থাকে ঘূর্ণাবর্তে। যিনি লিখছেন তিনি নিজেই কনফিউসড। নিজের কাছেই পরিষ্কার নন কি ঠিক আর কি ভুল। শুধু কিছু আবেগকে ভাষায় পরিণতি দেয়া। আজকে লেখক লেখা পড়াতে চান। পড়িয়ে নিতে পারে কি? সমাজের প্রতিফিলন সাহিত্যে আসে কি? ঘটনার প্রতিফলন আসে। ব্যঞ্জনা জাগে না। লেখা সুন্দর লেখার হাত সুন্দর। হাতের লেখা সুন্দর। শুধু অভাব রাসায়নিক বিক্রিয়ার। হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মিসলেই কি জল হয়? বাতাসে অক্সিজেন আর নাইট্রোজেন আছে। তবু বিক্রিয়ার জন্য চাই বিদ্যুৎ। সেই বিদ্যুতের ঝলক কোথায়। শুধু শব্দের গুড়গুড় রব । অনেকে আছে হিউমান সাইকোলজি হিসেব করে লেখেন। সুন্দর লেখা। শুধু বিভাব আর অনুভাবের সংযোগের অভাব। তাই রস আর নিস্পত্তি হয় না। লেখা হারিয়ে যায় বইয়ের পাতায় বা থেমে থাকে ফেসবুকের ওয়াল এ। অন্ধকার আসে শরীরের মিলন হয়। শুধু মুখোমুখি বসার জন্য বনলতা সেন আর নেই।


প্রসঙ্গ রামায়ণ

 রামায়ণের উত্তরাকান্ড। সীতার অগ্নিপরীক্ষা। সীতার আত্মত্যাগ নাকি নারীত্বের অবমাননা। এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন উত্তরাকান্ড মূল বাল্মীকি রামায়ণের অংশ নয়। কারণ লেখন শৈলী আলাদা। কেউ বলেন লব কুশ রামের সন্তান নয়। কেউ বলেন রাম আদর্শ রাজধর্ম করেছেন। কেউ আবার বলেন, রাম সীতাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছেন।আবার নানা রামায়ণের নানান মত। জনক নন্দিনী সীতা। জনক মানে পিতা। অর্থাৎ সীতা রামের বোন। তুলসীদাস রামায়ণের শিশু সংকলনে রয়েছে যে সীতা লঙ্কাতেই যাননি। রাবন যাকে নিয়ে গেছিলো সে সীতার রেপ্লিকা। আসল সীতা অগ্নিদেবের কাছে রক্ষিত ছিল। আমার কথা হলো রামায়ণ লিখেছেন বাল্মীকি। তাই বাল্মীকি যা লিখেছেন তার বাইরে কিছু কল্পনা করার কি প্রয়োজন। বাল্মীকি তো লক্ষ্মণ রেখার কোথাও লেখেননি।
 রামায়ণ কোন ভাষায় লেখা হয়? সেটা যে ভাষায় হোক, সংস্কৃত বা সমগোত্রীয় কিছু, ভাষাটা বৈদিক যুগের ভাষা।রাবণ ছিলেন ব্রাহ্মণ। রামচন্দ্র ক্ষত্রিয়। রামরাজত্বে শূদ্র বেদ পাঠ করেছিল। অর্থাৎ বাল্মীকি রামায়ণ বৈদিক যুগের আলোকে লেখা। বাল্মীকি আশ্রমে সীতা আশ্রয় নেয় আর লব কুশ কে প্রসব করে। অর্থাৎ রামায়ণ অনুযায়ী রাম আর বাল্মীকি সমসাময়িক। রামায়ণের সময় কাল তাহলে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৯০০ র মধ্যে। বিদেশী ঐতিহাসিকরাও রামায়ণের সময় কাল ওই বৈদিক যুগে স্থির করেছেন।
 কিন্তু প্রশ্ন হলো - এডামস ব্রীজ। যেটা রামেশ্বরম থেকে মান্নান দ্বীপ পর্যন্ত যুক্ত। লাইমস্টোন নির্মিত। এডামস ব্রীজ কে বানিয়েছেন আর কখন বানিয়েছেন? যদি এই ব্রীজ রামচন্দ্র বানান, তাহলে কোন সময় বানিয়েছেন? বৈদিক যুগে আর কোনো জায়ান্ট কনস্ট্রাকশন কেন নেই? খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ বা ৫০০ অব্দে যখন বুদ্ধদেব বা মহাবীর বৌদ্ধ বা জৈন ধর্ম প্রচার করছেন সেখানে এডামস ব্রীজ নিয়ে কোনো উল্লেখ কেন পাওয়া যায় না। 
 এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আগে দেখা যাক এডামস ব্রীজ কখন বানানো হয়েছিল। সেটা নিয়েও নানা মত। তবে জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া মতে এই ব্রীজ খ্রিস্ট পূর্ব ৭০০০ থেকে ১২০০০ এর মধ্যে বানানো হয়। অর্থাৎ রামচন্দ্র যদি বানর বাহিনী নিয়ে এই সেতু বানায় তাহলে রামচন্দ্র আর বাল্মীকি সমসাময়িক নন।অর্থাৎ উত্তরাকান্ড, সীতার অগ্নিপরীক্ষা আর রামের রাবন বধ কোনোটাই একসময়ের নয়। তাহলে সীতার অগ্নিপরীক্ষা থেকে রামচন্দ্রকে আলাদা করা যেতে পারে। অন্য ভাবে বললে, মূল রামায়ণে যে ঘটনা আছে সেটার সাথে উত্তরাকান্ডের কোনো যোগসূত্র নেই। বাল্মীকি মুনি রামচন্দ্রের লঙ্কা বিজয়কে বৈদিক আলোকে লিখেছেন। মূল ঘটনা প্রায় ৭০০০ থেকে ৮০০০ বছর আগের।
 বিজ্ঞান থেকে সরে এসে যদি জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে চর্চা করা যায় তাহলে রামচন্দ্রের জন্ম সময় হিসেবে যে গ্রহ নক্ষত্র হিসেব পাওয়া যায় সেটা খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ বছর আগের। অর্থাৎ ভারতে যখন এডামস সেতু তৈরী হচ্ছে তখন মিশরে পিরামিড তৈরী হচ্ছে। সবই জায়েন্ট কনস্ট্রাকশন। চীনের প্রাচীর, সেটাও ওই এক গোত্রের সুবিশাল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। 
 তাহলে বাল্মীকি রামায়ণ বৈদিক যুগের আলোকে লেখা কোনো সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক কাব্য। রামায়ণ অনুসারে যেটুকু ইতিহাস ফুটে ওঠে সেটা হলো - রামচন্দ্র উত্তর ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। মর্যাদা পুরুষোত্তম। দক্ষিণ ভারতে যারা থাকতেন, প্রবল পরাক্রমী আর বিজ্ঞান ও কারিগরী বিদ্যা তে প্রবল উন্নত। সেখানে সবথেকে শক্তিশালী রাজা বালী। আর সবথেকে পন্ডিত ও বীর হনুমান। রামচন্দ্র বালীকে আড়াল থেকে হত্যা করেন। সম্মুখ সমরে নয়। আর সেই যুগের ম্যানেজমেন্ট গুরু হলো জাম্বুবান। শ্রীলংকাতে প্রবল পরাক্রমী রাজা ছিলেন রাবন। তিনি মহা পন্ডিত ও ছিলেন। রাবন সমস্ত উত্তর ভারত জয় করেছিলেন কিন্তু দক্ষিণ ভারতে বালীকে হারাতে পারেননি। তাই দুজনে সন্ধি করেছিলেন। রামচন্দ্র রাবনের সাথে যুদ্ধ করে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করেন। আর সেই যুগেও ঘর শত্রুর অভাব ছিলোনা। যেমন বিভীষণ। সময়ের বিবর্তনে সেই ইতিহাস মুছে গেছে। মহর্ষি বাল্মীকি সেই ইতিহাস উদ্ধার করে মহাকাব্যের রূপ দিয়ে লিখে গেছেন। সীতার ভূমিকা রহস্যাবৃত। কারণ সীতা অযোনিসম্ভূতা। জনক রাজা সীতাকে চাষ করতে গিয়ে পেয়েছিলেন। তাই সীতার ইতিহাস বৈদিক যুগেই সীমাবদ্ধ থাকে।




আমার চোখে সত্যান্বেষী।

 সত্যান্বেষী শব্দটা একজন মানুষের কপিরাইট বলা যেতে পারে। শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়। বাঙালি ডিটেকটিভ ব্যোমকেশের অমর স্রষ্টা। ছোটবেলায় ব্যোমকেশের কিছু গল্প পড়েছি। কিন্তু ব্যোমকেশ সমগ্র অর্থাত সবকটা গল্প পড়া হয়নি। ব্যোমকেশ পড়তে গিয়ে সমস্যা হলো একবার পড়তে শুরু করলে আর থামা যায় না। তা সে রাত যতই হোক বা দিনে যত কাজই থাক। ব্যোমকেশ পড়তে পড়তে কিছু কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল সেটা থেকেই ইচ্ছে হলো আবার লিখতে। 
     সুকুমার সেন বলেছেন হোমস আর ব্যোমকেশের মধ্যে ওই অনুপ্রাসের ঝংকার টুকু ছাড়া মিল সামান্যই। চরিত্রগত অমিল বাদ দিলে গল্পের প্লট দিয়ে বিচার করলে কিন্তু কিছু কিছু মিল পাওয়া যায়। দেশলাই বাক্সের মধ্যে রাখা একটা দেশলাই কাঠির ধোয়া নিয়ে আসতে পারে নিশ্চিত মৃত্যু। সেই দেশলাই কাঠি দিয়ে একবার ব্যোমকেশকেও মারার চেষ্টা হয়। অপরাধী ধরতে ব্যোমকেশকেও অভিনয় করতে হয় মৃত ব্যক্তির। যেন কোনান ডয়েল এর প্লট। শার্লক হোমস অভিনয় করেন অসুস্থতার। ওয়াটসন কেও দেখতে দেননি পাছে ধরা পরে যান। অথবা পাতায় থাকা কেমিকাল আগুনে জ্বালাতেই আসে মৃত্যুর হাতছানি। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন ওয়াটসন আর শার্লক হোমস। 
তবু যদি কোনো বাঙালিকে কোনান ডয়েলের পাশে বসাতে হয় তিনি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাউন্টেন পেন না সাপের ছোবল। পেনের কালিতে সাপের বিষ। গল্পের বই কিন্তু টাকার পাতা। রনপা চড়ে ভূত। আঁকা ছবিতে প্রণয়ীর নীল চোখ। আর সেখান থেকে রহস্য উন্মোচন। এর কোনো তুলনা হয়না। শরীরে কথাও আঘাতের চিন্হ নেই। শুধু নাকের হাড় ভাঙ্গা। গল্পের ছলে একটি মেয়ের মায়ের নাম থেকে বুঝে গেলেন অপরাধী কে। পারালিসিস পা। কিন্তু চলতে সক্ষম।আধুনিক মেডিকেল সাইন্স। কোমরে ইনজেকশন করে সাময়িক অসাড়তা। পেয়াজের রস থেকে ইনভিসিবল কালি দিয়ে চিঠি তে উইল লেখা। এই সমস্ত প্লট আমার মনে হয়েছে কোনো বিদেশী লেখকের থেকে কোনো অংশে কম নয়। ব্যোমকেশকে সর্দার বল্লভভাই পটেল ডেকে পাঠিয়েছিলেন গুপ্তচর ধরতে। হয়ত কাল্পনিক প্লট। তবু গর্ব হয় বাঙালি হিসেবে।

আমি আগাথা ক্রিস্টি বেশী পড়িনি। চরিত্রের এত কঠিন নাম যে ভুলে যাই সেই চরিত্র কোথায় ছিল। এটা আমার মেমরি তে RAM এর প্রবলেম। ব্যোমকেশের গল্পে সেই সমস্যা নেই। কিন্তু ব্যোমকেশ পড়তে গিয়ে কিছু সমাজ চিন্তার উদয় হলো সেটা না লিখে পারছিনা। দুর্গ রহস্য তে বলা আছে সিপাহী বিদ্রোহের সময় সিপাহীরা লুটপাট করেছে বিহার অঞ্চলে। ইংরেজ আর বিদ্রোহী সিপাহী সবাই। জানিনা এমনটা তো ইতিহাসে পড়িনি। কিন্তু লেখন যখন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তখন একটু গবেষণা করে তো দেখতে হবে। শৈল্য রহস্য গল্পে 9 তারিখ সকালে কলকাতা থেকে পোস্ট করা চিঠি পুনা থেকে বাহাত্তর মাইল দুরে মহাবালেশ্বরে 12 তারিখের মধ্যে কিভাবে পৌছল আর 12 তারিখ সন্ধ্যার মধ্যে ব্যোমকেশ প্লেন করে কিভাবে কলকাতা পৌছে গেল এটা আমার মাথায় ঢোকেনি। যে মানুষ ডাক বাক্সের মধ্যে চুরি যাওয়া জিনিস লুকিয়ে রাখার মত প্লট ভাবতে পারেন তিনি একদম দিনক্ষণ দিয়ে পোস্টাল সিস্টেমকে এতবড় সার্টিফিকেট কি করে দিলেন সেটাও ভাবতে হবে। সজারুর কাঁটা গল্পে সজারুর কাঁটা কেন ইউস করা হলো পরিষ্কার হয় নি। তবু শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়। তিনি শ্রেষ্ঠ। হেমেন্দ্র কুমার রায়ের জয়ন্ত কিছুটা কাছাকাছি গেলেও একমাত্র ব্যোমকেশই পারে ঘাড়ের পেছনে ছুচ ফুটিয়ে খুন করার রহস্য সমাধান করতে আর তারপর সত্যবতীর সাথে প্রেম করতে। শুধু সেই সময়ের কিছু সাম্প্রদায়িক ঘটনার কথা গল্পে পড়তে গিয়ে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার আর অবিচারের কথায় হিন্দু হয়ে চোখে জল এসেছিল।
বাংলায় গোয়েন্দা গল্পের জনক বলাহয় পাঁচকড়ি দে কে (সুকুমার সেনের মতে)।   তাঁর আগে কিছু রহস্য কাহিনী লেখা হলেও সেটা ঠিক গোয়েন্দা গল্প নয়। কিশোর সাহিত্যে ফেলুদা আর পান্ডব গোয়েন্দা বেশ সুন্দর। সত্যজিৎ রায় শব্দ নিয়ে জাগলারি করলেও গল্পগুলো সিনেমার মতো মনে দাগ কাটেনি।  এটা ব্যাক্তিগত মতামত| বাংলায় আর এক গোয়েন্দা হলেন কিরীটি রায়।  প্রথম আত্মপ্রকাশ কালোভ্রমর গল্পে।  লেখক নীহার রঞ্জন গুপ্তের কথায় প্রথম গল্প বলে অনেক ভুল ভ্রান্তি থেকে গেছে গল্পে।  তবু গোয়েন্দা উপন্যাসটি উপভোগ্য।  হিন্দি সিনেমার মতো পরপর অ্যাকশন সিকোয়েন্স।  বর্ণনার ছটা সুন্দর।  তবে মগজাস্ত্রের শান কম।  প্রসঙ্গত সিনেমার জগতে আলোকপাত করা যেতে পারে। পরিচালক সত্যজিৎ রায়।  একদিকে ফেলুদা অন্যদিকে ব্যোমকেশ।  ফেলুদা সত্যজিৎ রায়ের নিজের সৃষ্টি।  ব্যোমকেশ হলো শরদিন্দু বাবুর ব্রেন-চাইল্ড। সিনেমার নাম সোনার কেল্লা যেখানে ফেলুদা ডিটেক্টিভ আর অন্য দিকে চিড়িয়াখানা যেখানে ব্যোমকেশ। ফেলুদার চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ব্যোমকেশের চরিত্রে স্বয়ং উত্তমকুমার। ১৯৭৪ সালে সোনার কেল্লা আর চিড়িযাখা ১৯৬৭ সাল।  মূল উপন্যাসের সাথে যদি তুলনা করা যায় তবে বিশ্লেষণটা প্রাঞ্জল হয়। সোনার কেল্লা একটা কিশোর সাহিত্য।  যেটা সত্যজিত রায়ের নিদর্শন কুশলতায় সমস্ত বয়সের দর্শকের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।  শিশু থেকে বয়স্ক সবাই দেখে বার বার। উপন্যাস হিসেবে চিড়িয়াখানা নিজেই স্বয়ং সম্পূর্ণ। চিড়িয়াখানা পড়লেই আনন্দ হয়।  সিনেমা  হিসেবে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত হলেও গল্পের বাঁধুনি সিনেমার উত্তেজনা কে সুন্দর ভাবে ধরে রেখেছে। সেই হিসেবে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত হলো সোনার কেল্লা অনেক বেশি পরিণত সিনেমা।       



আমার শ্রদ্ধা -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আধুনিক বাঙালী মনের দিশারী



আমার শ্রদ্ধা -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আধুনিক বাঙালী মনের দিশারী

নারী, পোশাক আর শরীর -এই তিনটি শব্দ সাহিত্যের ঊষালগ্ন থেকে লেখক আর পাঠক সবাইকেই একসূত্রে বেঁধে রেখেছে।  ব্রহ্মা যেদিন প্রথম অহল্যাকে সৃষ্টি করলেন সেটাই বোধহয় সাহিত্যের যৌবনকালের সূচনা।  অহল্যার সৃষ্টি পুরাণের গল্প।  সত্য মিথ্যা বিচার না করলেও চলবে।  তবে অহল্যার যৌবন সাহিত্যিকের কলমে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে।  কি পুরুষ কি মহিলা সকলেরই মনের মাঝে প্রথম ভাব রতি, প্রথম রিপু কাম, প্রথম রস শৃঙ্গার। অহল্যার সৃষ্টি আমার মনেহয় এক প্রতীক - সাহিত্যে নারীর স্থান। ২০১৬ সালের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত  বব ডিলানের কথায়: 
“I think women rule the world and that no man has ever done anything that a woman either hasn't allowed him to do or encouraged him to do.”
আর এখানেই মনেহয় অহল্যার জয়যাত্রা। ভাষা বাহন শিল্পে নারীর দুটো সৌন্দর্য। এক মানসিক আর দুই শারীরিক। নারীর শারীরিক সৌন্দর্য শিল্পের চোখে মনেহয় সবথেকে রহস্যে মোড়া এক অধ্যায় যা পুরুষ আর নারী দুজনকেই কোনো এক অদৃশ্য আকর্ষণে টেনে রেখেছে।নারীর দেহ বা শরীর যখন শিল্পের ভাষা পায়, তখন চারুশিল্প আর কারুশিল্পের সংমিশ্ৰনে সৃষ্টি হয় অজন্তা ইলোরার গুহাচিত্র, খাজুরাহের মন্দির। নারী পুরুষের মিলন সেখানে শিল্প। যৌনতা নয়। ভাষার লাবণ্যে কালিদাসের শকুন্তলা প্রাণ পায়। পার্বতী মহাদেবের সাথে শৃঙ্গার করে। অথচ কিছু শব্দের  (যেমন স্তন নিতম্ব, কাঁচুলি) অশুভ প্রয়োগে, বর্ণনার বৈগুণ্যে হয়েযায় নন্দিত থেকে নিন্দিত।
নারীর মানসিক সৌন্দর্যের আবেদন সাহিত্যে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার সাথে সমাজে অধিকমাত্রায় কার্যকর। আইনের ভাষায় ১৪ সেকেন্ডের বেশি কোনও মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে নাকি সেটা সেক্সচুয়াল হ্যারাসমেন্ট বলে গণ্য হয়। অথচ নির্ভয়ার ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড দিতে আইনের লেগেযায় চার বছর।  চোখের ভাষায় যখন প্রেম থাকে তখন সময়কে বেঁধে রাখা যায় না। আবার পুরুষের চোখের ভাষায় যখন থাকে লালসা, তখন হয় নৈতিকতার স্খলন। আর এই লালসা যখন শারীরিক হয় তখন হয় মানবতার পতন।  সেক্ষেত্রে মানসিক সৌন্দর্যের  আবেদন সাহিত্যের থেকেও সমাজে অনেক বেশী জরুরি।
পোশাকের সাথে মেয়েদের একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। স্বামী বিবেকানন্দের কথায় (প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শীর্ষক প্রবন্ধে পোশাক অধ্যায়ে) পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে মেয়েরা বুক খোলা  সান্ধ্য পোশাক পরে অতিথিদের আপ্যায়ন করে।  ভারতে আবার অতিথি এলে মহিলারা ঘোমটা টেনে নেয়।  ঘোমটা টানতে গিয়ে মেয়েদের আবার কোমর থেকে কাপড় উঠে গেলেও খেয়াল থাকে না।  রাজদরবারে  নর্তকীরা তো দিব্বি উলঙ্গ।   কোমর থেকে কয়েক ফালি কাপড় ঝুলছে তাতেই তারা স্বচ্ছন্দ।  বাস্তবিক পক্ষে পোশাক একজন মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা।  পোশাকের সাথে শারীরিক সৌন্দর্য্যের প্রত্যক্ষ সংযোগ থাকলেও মানসিক সৌন্দর্যের কোনো সম্পর্ক নেই।  আর এই ভুলটাই বার বার করে আমরা মানসিক সংকীর্ণতার পরিচয় দিতে থাকি।    
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পের চরিত্রগুলোকে বুঝতে গেলে আজকের সামাজিক সমীকরণের দিতে একটু দৃষ্টিপাত করা দরকার।  প্রচলিত কনভেনশন হলো সম্পর্কের ছেলের বয়স বেশি মেয়ের কম -এটাই কাম্য।  কোনো কোনো মেয়ে আবার দশ বছরের বেশি পার্থক্যকে সঠিক বলে মনে করেন।  বিষয়টা মূলত নির্ভর করে মেয়েদের বায়োলজিক্যাল সার্কলের ওপর।  মেয়েদের মানসিক ম্যাচুরিটি ছেলেদের থেকে আগে আসে আবার মেনোপজ মেয়েদের অনেক আগে আসে।  ছেলেদের সেই অর্থে অনেক পরে। শারীরিক প্রয়োজনের সাথে অর্থনৈতিক স্টেবিলিটিটাও জরুরি। অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর হতে গেলে ছেলেদের অনেকটা সময় লেগে যায়।  মেয়েদের সন্তান ধরণের সাথে বয়সের একটা যোগসূত্র থাকায় স্বাভাবিক নিয়মেই মেয়েদের একটি নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে অধিক বয়সের অর্থনৈতিক স্বনির্ভর ছেলের সাথে বিয়ে দেয়া হয়। এটাই রীতি।   আজকের দিনে দাঁড়িয়ে  সমাজে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ছেলে মেয়ে দুজনকেই আজকের দিনে স্বনির্ভর হওয়া জরুরি। তাই ছেলে বা মেয়ে দুজনকেই ক্যারিয়ার গড়তে বেশ কিছুটা সময় দিতেই হয়।  আধুনিক কসমেটিক সায়েন্স মেয়েদের যৌবনকে অনেক বেশি পরিণতি দিয়েছে। এখন পঞ্চাশ বছরেও মেয়েরা পূর্ণ যৌবনা।  মেডিকেল সায়েন্সের কল্যানে মেনোপজের পর যৌন ইচ্ছা পূর্ণ মাত্রায় বর্তমান থাকে।  এক প্রখ্যাত সাহিত্যিকের একটা লেখায় দেখলুম -থোড়াই কেয়ার, লুব্রিক্যান্ট আছে তো। বিভিন্ন সাহিত্যিকের লেখা থেকে দেখেছি পরিণত বয়স্ক মেয়েদের, অপেক্ষাকৃত কম বয়সের ছেলেদের প্রতি একটা মনের টান তৈরী হয়।  আজকের সমাজে মানুষের জীবনদর্শন অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছে। ছেলে বা মেয়ে সবাই ক্যারিয়ার কে সবথেকে প্রায়োরিটি তে রাখে।  তারপর লাইফপার্টনার।  ছেলের চাকরি মেয়ের বিয়ে -এই ট্রাডিশনাল ধারণা আর নেই।  এখন সবার শিক্ষা, সবার অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, দুজনের সংসার।  প্রসঙ্গত পোস্ট ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার নিয়ে আজকাল অনেক কথা হচ্ছে।  এই প্রসঙ্গে কিছু কথা এখানে বলার অবকাশ রাখে।  সমস্ত প্রাণিজগতে পলিগ্যামী (একাধিক সঙ্গী বা সঙ্গিনী)একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য।  মানুষের সমাজে মোনোগ্যামি (এক সঙ্গী বা সঙ্গিনী)  একটা আরোপিত বৈশিষ্ট্য।  অর্জিত নয় (জেনেটিক ক্যারেক্টার নয়) । ফলে সমাজে মানুষ যত ব্যক্তি স্বাধীনতা খুঁজবে, ততই ওই ডরম্যান্ট পলিগ্যামি জীন প্রকট হতে  থাকবে।  যদিও এটা ব্যক্তিগত মতামত তবু অনেকটাই বায়োলজি  সমর্থিত। মিউটেশন আর লামার্ক মতবাদ নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করে আমার মনেহয়েছে  কথাটা বিতর্কিত হলেও খুব একটা ভুল নয়। যেমন কুড়ি প্রজন্ম ধরে ইঁদুরের লেজ কেটে দিলেও লেজকাটা ইঁদুর জন্মায়না।  কারণ আরোপিত বৈশিষ্ট্য বংশানুসরণ করেনা। কোনো ক্যারেক্টার যখন জেনেটিক্যালি অর্জিত হয় তখনি সেই বৈশিষ্ট্য বংশানুসরণ করবে।   তাই মানুষ হিসেবে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে আত্মসম্মান আর সামাজিক স্বীকৃতি - এই দুটি বিষয় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ।  বয়স বা বহুগামিতা এগুলো গৌণ। 
  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখতে গিয়ে নারীর পোশাক আর শরীর এই নিয়ে এতো বিস্তারিত ভূমিকা করা বিশেষ প্রয়োজন ছিল। রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী আধুনিক সাহিত্যের কোনো নির্দিষ্ট সূচনাকাল না থাকলেও মোটামুটি ভাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কীর্ত্তিবাস পত্রিকাকে একটা মাইলস্টোন ধরা যেতে পারে।  আধুনিক বাঙালীকে যে মানুষটা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন তিনি সুনীলবাবু। এই স্বাধীনতার মূল বিষয় অবশ্যই  নারী স্বাধীনতা।  নারীর পোশাকের স্বাধীনতা।  নারীর আবেদনের স্বাধীনতা।  পোশাকের সাথে মনের বা চরিত্রের যে কোনো সম্পর্ক নেই, সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে সেটাই সুনীলবাবু শিখিয়েছেন।  সাহিত্যের ভাষায় উনি বাঙালিকে পরিণত করেছেন।  স্বাধীন করেছেন।  নারীর আবেদনকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। কোনো মেয়ের শরীরের আবেদন আস্বাদনে  কোনো অপরাধ নেই, যদি সেই আস্বাদন বা স্বাদ সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে, সম্মানে মধ্যে দিয়ে, সৌজন্যের মধ্যে দিয়ে হয় ।  সুনীলবাবু মেয়েদেও স্বাধীন করেছেন।  ভালোবাসলে চুমু খাওয়া অপরাধ নয়।  শরীরের টান পুরুষ মহিলা দুজনেরই আছে। সুনীলবাবু বাঙালী পুরুষ বা নারী দুজনের হাতেই হুইস্কির গ্লাস স্বচ্ছন্দে তুলে দিয়েছেন।  কোনো যুবতী মেয়ের চলার ছন্দে কোমর আর বুকের আন্দোলন উপভোগ করতে শিখিয়েছেন।  সুন্দরী যুবতীকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়া যুবককে দেখে মনে ঈর্ষা জাগাকে উনি সম্মান করেছেন।  স্বামীর অবর্তমানে স্বামীর বন্ধুর সাথে বৌয়ের ফ্লার্টিং উনি স্বচ্ছন্দে স্বীকৃতি দিয়েছেন। স্বামীকে লুকিয়ে পুরোনো প্রেমিকের সাথে শারীরিক মিলনকে ওই স্বাগত করেছেন।  দুজন মহিলার কোমরের সৌন্দর্য কে উনি তারিফ করেছেন।  কিছু কিছু পুরুষের তীব্র আকর্ষণ শক্তির কাছে মেয়েদের অসহায় সমর্পনকে উনি গ্রহণ করেছেন।  পরকীয়া, পোস্ট ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার, একাধিক সম্পর্ক, কিশোর কিশোরীর চুম্বন, হুইস্কির গ্লাস সবকিছুই সুনীলবাবুর ভাষায় সাবলীল। 

তবু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।  কোনো পুরুষ কোনো মেয়ের চুলের ঘ্রান নিয়ে তারিফ করতে পারে, বলপূর্বক বুকে হাত দিতে পারেনা। মেয়েদের সম্মান করলে গুন্ডাও ভয় পায় একজন নিরস্ত্র মানুষের গায়ে হাত দিতে। সুনীলবাবুর স্বাধীনতায় সম্মান আর সৌজন্যবোধ সবসময় অগ্রাধিকার পেয়েছে। সম্মতি ছাড়া কোনো মহিলাকে স্পর্শ করাকে উনি কখনোই সমর্থন করেননি।   আজকের সমাজে তাই সুনীলবাবুর সমস্ত লেখাকে ভীষণ প্রাসঙ্গিক মনে হয়।  উনি ওনার সময় থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আধুনিক ছিলেন।  ওনার সময় মোবাইল ফোন ছিলোনা।  তবু উনি সেই সময় যে আধুনিক মুক্ত মনের সমাজের কথা বলে গেছেন, সেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা আর আত্মসম্মান সর্বাধিকার পেয়েছে।  একজন ধর্ষিতা মেয়ের চোখের জলের সম্মান দিয়ে একজন বাবার যন্ত্রনা উনি বৃক্ষরোপনের মধ্যে দিয়ে মুক্ত করেছেন। অনেক দাম্পত্য প্রেমের শিকড় পুরুষ বা নারীর শারীরিক আবেদনের ওপর নির্ভর করেনা, নির্ভর করে মানসিক টানের ওপর।  আজকের সমাজে যখন সাধারণ সম্পর্কগুলো দিক খুঁজে পায়না, ভালো মন্দের দ্বন্দ্বে সমাসবদ্ধ হয়না, তখন সুনীলবাবুর প্রতিটি লেখাকে মনেহয় সবথেকে প্রাসঙ্গিক। সুনীল বাবুর লেখা থেকে লাইন তুলে প্রতিটা কথার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।  সেক্ষেত্রে এটা থিসিস পেপার হয়ে যাবে। আজকের সমাজে সুনীল বাবুর প্রাসঙ্গিকতাকে বোঝার জন্য, ওনার উপন্যাস, গল্প বার বার পড়া দরকার। আমার প্রিয় সাহিত্যিক কে এটাই আমার শ্রদ্ধার্ঘ।     

অবতার - চৈতন্যদেব এবং শ্রীরামকৃষ্ণদেব





অবতার কথার অর্থ হলো "জীবদেহধারী ঈশ্বর বা দেবতা"| অবতার বলতে আমাদের মনে যে ধারণাটা আসে সেটা হলো - স্বর্গ বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে কিছু হাত পা যুক্ত দেবতা ঘুরে বেড়ান।  সেই দেবতা এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে মানুষকে  বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। বৈদিক সাহিত্যে অবতার শব্দটি পাওয়া যায় না।  তবে বেদ-পরবর্তী সাহিত্যে এটি ক্রিয়াপদ আকারে উল্লিখিত হয়েছে। মূলত খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর পরে রচিত পৌরাণিক সাহিত্যেই এই শব্দটিকে স্বতন্ত্রভাবে বিশেষ্য পদের আকারে ব্যবহার করা হয়েছেঅবতার বলতেই আমাদের মনে ভগবান বিষ্ণুর দশাবতার কথাটি মনে আসে।   মহাভারতে কৃষ্ণকে বলাহয় বিষ্ণুর অবতার।  মহাভারতে আর একটি চরিত্র হলো যুধিষ্ঠিরযুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র।  কিন্তু অবতার ননযুধিষ্ঠির রূঢ়ি শব্দ| ব্যাকরণগত ভাবে রূঢ়ি শব্দ বলে একটি বিশেষ প্রকার শব্দ আছে।  যেমন পঙ্কজ।  পাঁকে জন্মালেই সে পঙ্কজ নয়।  পঙ্কজ মানে পদ্মফুল।  মহাভারতে যুধিষ্ঠির সেইরকম রূঢ়ি শব্দ।  যুদ্ধে স্থির।  তাই যুধিষ্ঠির।  অলুক অধিকরণে উপপদ তৎপুরুষ।  যুধিষ্ঠির যুদ্ধে স্থির হলেও চিন্তাশীলতায় স্থির নয়।  জুয়া খেলায় আসক্ত।  নিজের স্ত্রীকেও বাজি রাখছেন। যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র হলেও শ্রেষ্ঠ মানুষ বলা যায় না। মহাভারতে কৃষ্ণ অবতার। ব্যুৎপত্তি গত ভাবে কৃষ্ণ কথাটি কৃষ থেকে এসেছে।  কৃষ মানে চাষবাস করা।  কৃষ্ণ কৃষকাজের সাথে যুক্ত। গরু পালন করতো।   মহাভারতদের প্রেক্ষাপটে শ্রীকৃষ্ণ অবতার। শ্রীমদ্ভগবতগীতায় যদা যদা হয় ধর্মস্য।...শ্লোকে অবতার কথার উল্লেখ না থাকলেও অবতারের উপযোগিতার সমর্থন মেলে।    বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণচরিত প্রবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে কৃষ্ণ কোনো মহাপুরুষ নয়।  তবে সেই যুগের অনুপাতে অত্যন্ত প্রগতিশীল মানুষ।
 মধ্যযুগে চৈতন্যদেব আর আধুনিক যুগে শ্রী রামকৃষ্ণদেব অবতার বলে অবিহিত।  ভক্তরা শ্রী রামকৃষ্ণকে অবতার বরিষ্ঠ বলেছেন।  অবতার কথাটি শাস্ত্রীয় ভাবে বিচার করলে, অবতারের যে ডেফিনেশন দেয়া আছে এই পথে এগোতে হবে।  অবতার, সাধারণ মানুষ হয়ে জন্মালেও তাঁর মধ্যে এমন বিশেষ কিছু গুন থাকবে যা দুষ্কৃতীদের থেকে সাধুদের উদ্ধার করে ধর্ম সংস্থাপন করবে,  সাধারণভাৰ মানুষের চোখে সহজে ধরা পড়বে না, শুধু ভক্তরা লক্ষণ দেখে বিচার করবেন যে তিনি সাধারণ মানুষ নন। চৈতন্যদেব আর শ্রী রামকৃষ্ণ সেই অর্থে সাধারণ মানুষ। তাঁদের ক্রিয়া কলাপ তৎকালীন মানুষের কাছে অপাত ভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ লেগেছিলো।  ভক্তদের কাছে তাঁদের বিশেষ ক্ষমতা বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে। সেই হিসেবে এনারা অবতার।   অবতার সাধারণ মানুষ।  শুধু তাঁদের মধ্যে এমন কিছু গুণ থাকে যার জন্য সমকালীন মানুষের থেকে তারা অনেক যুগ এগিয়ে থাকেন। অবতারের এই বৈশিষ্ঠ্য চৈতন্য চরিতামৃতের মধ্যলীলার শ্লোকে পরিষ্কার ভাবে বলা আছে। 
"অবতার নাহি কহে আমি অবতার। মুনি সব জানি করে লক্ষণ বিচার।"
"সৃষ্টি হেতু যেই মূর্তি প্রপঞ্চে অবতরে, সেই ঈশ্বর মূর্তি অবতার নাম ধরে।"
ঈশ্বরত্ব হলো মানুষের এমন একটা ক্ষমতা বা গুন্ যাতে মানুষের মন লোভ লালসার ওপর পতিত হলেও লিপ্ত হয় না| প্রসঙ্গত ভাগবতের প্রথমস্কন্ধে তৃতীয় অধ্যায়ে অবতারের কথা বলা হয়েছে। বিশ্ব কার্যের নিমিত্ত অবতার আবির্ভূত হন। যমুনাচার্য স্তোত্রে 18 নং শ্লোকে (মায়াবলেন ভবতাপি। ....) আছে অবতার মায়াবলের দ্বারা নিজেকে গোপন করে রাখে। যারা ভক্ত, অবিরত ঈশ্বরের ধান করে, তারা অবতারের স্বরূপ অনুভব করে।
রামকৃষ্ণদেব যখন কর্মজীবনে আসেন তখন হিন্দু সমাজে নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়িয়ে রয়েছে। মূর্তিপূজা নিয়ে প্রচুর কুসংস্কার সমাজকে গ্রাস করে ছিল। খৃস্টান মিশনারিরা হিন্দুদের নিচু চোখে দেখতেন আর হিদেন, প্যাগান ইত্যাদি বলতেন। ডিরোজিওর প্রভাবে অনেকে খৃস্টান হয়ে গেছিলো।  ভারতে রেনেসাসের প্রতীক রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।  এতে ধর্মীয় গোড়ামি আর কুসংস্কার হয়তো মুছেছিলো তবু প্রকৃত হিন্দু দর্শনের সঠিক মূল্যায়ন হলোনা। সেই সময় রামকৃষ্ণদেব এসে শোনালেন - যত মত তত পথ। এতবড়ো দর্শন আর কোনো মহাপুরুষ বলেছেন কিনা সন্দেহ।  মা কালীর প্রতি তাঁর মাতৃভাবে সাধনা মূর্তি পুজোতে শাস্ত্রীয় ভাবনার বাস্তব প্রয়োগ প্রদর্শিত হলো।  স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ভাষণে এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।  স্বামীজী যে, রামকৃষ্ণদেবের এই মূর্তিকে মাতৃ জ্ঞানে ভালোবাসার দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন সেটা পরিষ্কার ভাবে লেখা আছে। অধ্যাত্ম জীবনে রামকৃষ্ণদেব তোতাপুরীর কাছে পুরী মন্ত্রে দীক্ষা নেন।  পুরী হলো শঙ্করাচার্যের দশনামী সম্প্রদায়ের এক সম্প্রদায়।  চৈতন্যদেব প্রথমে পুরী পরে ভারতী মন্ত্রে দীক্ষিত।  রামকৃষ্ণদেব এবং শ্রীচৈতন্যদেব দুজনেই কঠোর ভাবে সন্ন্যাস ধর্ম মানেননি।  ব্রহ্মবৈবর্ত্যবচনম  কৃষ্ণ জন্মখন্ডে ১০৫/১৮০ উক্তি অনুযায়ী কলিকালে অস্যার্থ, সন্ন্যাস বর্জ্য।  হয়তো সেটাই ফুটে উঠেছে রামকৃষ্ণদেব আর চৈতন্যদেবের মধ্যে।
প্রশ্ন আস্তে পারে, রামকৃষদেব কি সত্যি মা কালীকে দেখতেন? উত্তর হলো, হ্যা দেখতেন। রামকৃষ্ণদেব যে মা কালীকে দেখতেন সেটা বিজ্ঞান দিয়ে কি সমর্থন করা যায়? উত্তর হলো বিজ্ঞান দিয়ে না হলেও দর্শন (ফিলোজফি) দিয়ে সমর্থন করা যায়। রামকৃষ্ণদেবের মা কালীকে দর্শনের নাম অ-পরোক্ষ দর্শন। আচার্য ভরতের সূত্র প্রয়োগ করলে ব্যাপারটা হলো - রামকৃষ্ণদেবের মনের মাতৃভাব, বিভাব আলম্বন মা কালীর মূর্তির মধ্যে দিয়ে রস পর্যায় পৌচচ্ছে। রস অ-লৌকিক। রামকৃষ্ণদেব যেন মা কালীকে দেখছেন। এটাই হলো অ-পরোক্ষ দর্শন। সেই হিসেবে মূর্তি বা পুতুল পুজো না করলে কখনোই রসপর্যায় পৌঁছনো যাবে না। তাই মা কালীকে দেখতে গেলে পুতুল পুজো চাই-ই চাই| চৈতন্যদেবের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু কোনো রকম। আচার্য ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে যে ভালোবাসার কথা বলেছেন সেটাকে শাস্ত্রীয় ভাষায় বলে উজ্জ্বল-বেসাত্মক।  যেখানে নায়ক আর নায়িকা দুজনেই সমান সুখ উপভোগ করে।  এটাই হলো সাধারণ মানুষের ভালোবাসা, রতি বা কাম। বৃন্দাবনের রাধা যে কৃষ্ণকে ভালোবাসতেন সেটা রাগাত্মিকা।  রাগাত্মিকা রতিতে নায়িকা মানে রাধার সুখ বংহীয়স (অধিকতর)। রাধা হলো বৃন্দারক (মুখ্য)| কোনো কোনো বৈষ্ণব সাহিত্যকারের বিচারে চৈতন্যদেব রাধার কিভাবে অধিক সুখ হয় সেটা অনুধাবন করতে অবতার হিসেবে এসেছিলেন। আর এক প্রকার ভক্তির কথা আছে সেটা হলো রাগানুগা। চৈতন্যদেবের নির্দেশে রুপগোস্বামী উজ্জ্বলনীলমণি গ্রন্থে এই ভক্তির কথা বলেছেন। এখানে নায়িকা, নায়কের সুখের জন্য সব সুখ বিসর্জন দিয়েছে|   
ভগবান সম্পর্কে শ্রী রামকৃষ্ণদেবের কিছু কথা ইংলিশে লিখলে -According to the book "Ramakrishna" by Prof Max Muller, the clarification given by Shri Ramakrishna on God & Soul is very simple. God is one who tells a thief to steal and simultaneously alert the house owner against theft. Soul is like the plug in syringe. Soul remains in body but not its parts. Correlation of soul and god is like a pot kept inside water, where water remains both inside ad outside of the pot. Importance of god in human being is like the oil in lamp, without which lamp cannot be enlightened. To reach the god, proper training is required, similar to the trained person can catch and play with poisonous snake.
চৈতন্যদেবের জীবনী নিয়ে মূলত চারখানি গ্রন্থ লিখিত হয়েছে। বাংলাপিডিয়া অনুসারে: সংস্কৃতে রচিত প্রথম জীবনীগ্রন্থ চৈতন্যচরিতামৃত। এর রচয়িতা মুরারি গুপ্ত ছিলেন চৈতন্যদেবের সতীর্থ। গ্রন্থখানি গদ্য-পদ্যের মিশ্রণে ‘কড়চা’ বা ডায়রি আকারে রচিত। এজন্য এটি ‘মুরারি গুপ্তের কড়চা’ নামেও পরিচিত। এতে শ্রীচৈতন্যের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা আছে। বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম জীবনীকাব্য  চৈতন্যভাগবত (১৫৪৮) তাঁর মৃত্যুর ১৫ বছর পরে রচিত হয়। শ্রীচৈতন্যের ঘনিষ্ঠ সহচর নিত্যানন্দের উৎসাহে বৃন্দাবন দাস প্রায় ২৫ হাজার জোড় চরণে এ বিশাল কাব্য রচনা করেন। মুরারি গুপ্ত রাধাকৃষ্ণের যুগলরূপ হিসেবে চৈতন্যদেবের ভাবমূর্তি তুলে ধরেন, আর বৃন্দাবন দাস শ্রীকৃষ্ণের অবতাররূপে চৈতন্যলীলা প্রচার করেন। সময়ের দিক থেকে লোচনদাসের  চৈতন্যমঙ্গল (১৫৭৬) দ্বিতীয় এবং ষোলো শতকের শেষদিকে একই নামে জয়ানন্দ রচনা করেন তৃতীয় গ্রন্থ। তুলনামূলকভাবে লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল অধিক পরিশীলিত ও বৈদগ্ধ্যপূর্ণ। তিনি নিজ বাসস্থান শ্রীখন্ডের ভাবধারা অনুযায়ী ‘গৌরনাগর’ রূপে শ্রীচৈতন্যের ভাবমূর্তি তুলে ধরেন। চৈতন্যদেবের চতুর্থ জীবনীকাব্য  কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত 'চৈতন্যচরিতামৃত' (১৬১২)। কৃষ্ণদাস বৃন্দাবনের অন্যতম গোস্বামী রঘুনাথ দাসের শিষ্য ছিলেন। প্রামাণিক তথ্য, বিষয়বৈচিত্র্য, রচনার পারিপাট্য প্রভৃতি গুণে কাব্যখানি পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। চৈতন্যজীবন মুখ্য বিষয় হলেও এতে বৈষ্ণবধর্মের তত্ত্ব, দর্শন, বিধিবিধান, সমকালের ইতিহাস, সমাজ এবং ঐতিহ্যের নানা তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। রাধাকৃষ্ণের যে ঐশী প্রেম ও ভক্তিবাদের ওপর গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম প্রতিষ্ঠিত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রীচৈতন্যকে তারই বিগ্রহরূপে চিত্রিত করেছেন। পাঠকনন্দিত এ কাব্যখানির একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডওয়ার্ড সি ডিমকের ইংরেজি গদ্যানুবাদ টনি কে স্টুয়ার্টের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে।চৈতন্য চরিতামৃত  কৃষ্ণদাস কবিরাজ কর্তৃক প্রণীত। এটি কৃষ্ণ চৈতন্যের (১৪৭৮-১৫৩৩) প্রতি নিবেদিত চরিত সাহিত্য ধারার চূড়ান্ত প্রামাণ্য রচনা হিসেবে মর্যাদাময় আসনে অধিষ্ঠিত। গ্রন্থটির মূল পাঠ ষড় গোস্বামীদের দ্বারা বিকশিত অধিবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা ও নন্দনতত্ত্বের মৌলিক তত্ত্বীয় অবস্থানের রূপরেখা দান করে এবং ভক্তজনোচিত ধর্মীয় কৃত্যের সারবস্ত্ত ব্যক্ত করে। এটি যেহেতু বিশ্বকোষের মতো, সে কারণে এটি ঐতিহ্যের ধারায় সবচেয়ে পুনর্গঠিত পাঠ এবং অন্যসব রচনার মাপকাঠিতে বলা যায় যে, এটি ধর্মতাত্ত্বিক রচনার যথার্থ মান সৃষ্টি করেছে।
চৈতন্যদেবের অবদান আলোচনা করতে গেলে প্রথমে তৎকালীন যুগে গঙ্গার ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর আলোকপাত করা দরকার।অধুনা কৃষ্ণনগর থেকে প্রায় ১৬ কিমি দূরে ধুবুলিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রায় ৩ কিমি আগে বেলপুকুর বলে একটা গ্রাম আছে।  সেই গ্রামের পাস দিয়ে একটা খাল বয়ে গেছে যেটা স্থানীয় মানুষের ভাষায় আদি গঙ্গা।  প্রচলিত কথায় আঠেরোশো সালে প্রবল বন্যায় গঙ্গা দিক পরিবর্তন করে।  দিক পরিবর্তনের পর বর্তমান গঙ্গার প্রবাহ পথে গঙ্গার একদিকে নবদ্বীপ আর ওপর দিকে কৃষ্ণনগর।  বর্তমানে কৃষ্ণনগর আর শান্তিপুর গঙ্গার একই দিকে অবস্থিত।  কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃতে লেখা আছে  চৈতন্যদেবের সময় শান্তিপুর আর নবদ্বীপ গঙ্গার একই পাড়ে ছিল। বর্তমান বেলপুকুর গ্রামের খাল আদি গঙ্গা হিসেবে ধরে নিলে  এই হিসেবে মিলে যায় যে চৈতন্যদেবের সময় শান্তিপুর আর নবদ্বীপ একই দিকে ছিল। 
চৈতন্য দেবের সময় বাংলায় হুসেন শাহের আমল চলছে।উইকিপেডিয়ার তথ্য হিসেবে  মাদালা পাঞ্জির মতে হুসেন শাহের সেনাপতি শাহ ইসমাইল গাজি ১৫০৮-০৯ সালে মান্দারান দুর্গ (বর্তমান হুগলি জেলা) থেকে তার অভিযান শুরু করেন এবং পুরি পৌছান। পথে জজপুর ও কটক আক্রমণ করা হয়। উড়িষ্যার গজপতি শাসক প্রতাপরুদ্র দক্ষিণের অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন। এ সংবাদ পেয়ে তিনি ফিরে আসেন। তিনি বাংলার সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন ও বাংলার সীমান্ত পর্যন্ত তাদের পিছু নেন। আর. সি. মজুমদার দাবিমতে উড়িষ্যা অভিযানের সময় তিনি কিছু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেন। (তথ্যসূত্র: উইকিপেডিয়া)   হুসেন শাহের মন্ত্রীদের মধ্যে দুজন হিন্দু উচ্চ পদে আসীন ছিলেন -রূপ গোস্বামী আর সনাতন গোস্বামী। রূপ গোস্বামী আর সনাতন গোস্বামী চৈতন্যদেবের অনুসারী হন|চৈতন্য চরিতামৃতে যেভাবে ঘটনার বর্ণনা আছে তার সাথে তৎকালীন ইতিহাস মেশালে মোটামুটি যে কাহিনী দাঁড়ায় সেটা হলো - হুসেনশাহের মূল কূটনৈতিক পরামর্শদাতা ছিলেন রূপ গোস্বামী আর সনাতন গোস্বামী। হুসেনশাহ উড়িষ্যা দখল করার জন্য এই দুজন মন্ত্রীর থেকে পরামর্শ চান।  উড়িষ্যায় তখন হিন্দু শাসন চলছে।  এই দুজন মন্ত্রী চৈতন্যদেবকে উড়িষ্যা দখলের অভিপ্রায় জানান।  চৈতন্যদেব ওনাদের বৃন্দাবন চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন।  হুসেনশাহ সনাতনকে বন্দী বানিয়ে ফেলেন।  পরে সনাতন ঘুষ দিয়ে জেল থেকে পালিয়ে যান।  প্রথমে পালতে ব্যর্থ হলেও পরে পালতে সক্ষম হন।  চৈতন্যদেব নিজে পুরী যান।  সেখানে কৃষ্ণনাম প্রচার করেন।  হুসেনশাহ চৈতন্যদেবের ক্ষমতা জানতেন। তাই তিনি পুরী আক্রমণের আর চেষ্টা করেননি।  আসলে চৈতন্যদেব পুরীকে মুসলিম আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন।  চৈতন্যদেব ছিলেন ভারতে প্রথম অহিংস আন্দোলনের জনক।  যদিও এই কথার কোনো ঐতিহাসিক সমর্থন নেই।  তবু বিভিন্ন ঘটনা কোলাজের মতো সাজালে এই চিত্রই সামনে আসে। 

নদীয়াতে কাজী হরিনাম সাধনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে চৈতন্যদেবের নির্দেশে শান্তিপুর নবদ্বীপ (নদীর একই পাড়ে নবদ্বীপ আর শান্তিপুর) আর কৃষ্ণনগরের দিক থেকে দলে দলে কীর্তনিয়া কাজীর বাগানে এলে কাজী ভয় পেয়ে যান এবং চৈতন্যদেবের সাথে সমঝোতা করেন।  হুসেন শাহ কাজীকে নির্দেশ দেন চৈতন্যদেবের সাথে কোনো সংঘাত না  করতে।  চৈতন্যদেবের প্রথম স্ত্রী সাপের কামড়ে মারা গেলে চৈতন্যদেব ঝুড়ি কোদাল নিয়ে জঙ্গল সাফাই অভিযান করেন (লোচনদাস ঠাকুরের চৈতন্যমঙ্গল)। স্বচ্ছ ভারত অভিযানের এটাই আদি সূচনা।  চৈতন্যদেব নিজে কুসংস্কার মানতেন না।  বৃন্দাবনে থাকার সময় নদীতে জেলেদের নৌকায় প্রদীপ দেখে গ্রামবাসী ভেবেছিলো কৃষ্ণ ঠাকুর নাচ করছেন।  চৈতন্যদেবের পার্ষদ ওনাকে কৃষ্ণ দর্শনের জন্য অনুরোধ করলে উনি মূর্খের মতো কথা বলে তিরস্কার করেন আর এটাও বলেন যে কলিকালে কি কৃষ্ণ ঠাকুর আস্তে পারে? (চৈতন্যচরিতামৃত)।চৈতন্যচরিতামৃততে যেভাবে ওনার মৃত্যুর বার্তা আছে সেটা হলো - পায়ে আঘাত লেগে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।  আধুনিক বিজ্ঞানের চোখে দেখলে ওনার সেপ্টিসেমিয়া হয়ে যায়।  উনি যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে বিকারগ্রস্থ অবস্থায় সমুদ্রে ঝাপ দেন।  পরের দিন কোনার্কের কাছে এক জেলের মাছের জালে ওনার দেহ পাওয়া যায়।  সমুদ্রের লবন জলে ওনার শরীরের রং পরিবর্তিত হয়ে যায়। কোনার্কের কাছে ওনার দেহ দাহ করা হয়।  তবে ওনার মৃত্যুর খবর প্রচার হতে দেয়া হয়নি। চৈতন্যচরিতামৃতে আছে - না হয় "চাউল"। এখানে পাণিনির র আর ল অভেদ সূত্র প্রয়োগ করলে চাউল কথাটা হয়ে যায় চাউর।  চাউল কথাটা বাউল শব্দের সাথে ছন্দ মিল করতে বলা হয়েছে।  কিছুটা হেঁয়ালিও বটে।    এটা লেখকের (আমার)  অনুমান যে  মুসলিম শাসকের কাছ থেকে ওনার মৃত্যু সংবাদ গোপন করা হয়েছিল বৃহত্তর স্বার্থে।